shafiq nohor

বুধবার, ৩ জুলাই, ২০২৪

অন্য মানুষ শফিক নহোর

 এই গ্যাদা তোদের বাড়িতে আগুন আছে ?

একটু আগুন দে।

আগুন না থাকলে বিষদে

নেই, কাকা কিছুই নেই।

কবে শুনবি, দেশ নেই, মানুষ নেই, শহরে মশা নেই।

নদীর জল নেই, কৃষকের আনন্দ নেই

আয় আমরা সবাই দল বেঁধে মরে যাই।


মরে যাবার আনন্দে আমরা আবার বেঁচে থাকবো

মানুষ এখন ইচ্ছে করলেই আর মরতে পারে না।

মরে যাওয়া একটা নেশা 

দেখছিস না সবাই মরে যাচ্ছে; অসুখে, হিংসায়।


অন্যমানুষ- শফিক নহোর 


সোমবার, ১ জানুয়ারী, ২০২৪

অদিতি ও অনুভূতি || শফিক নহোর

 তুমি অনুভূতি দ্বিপ্রহর 

মুছে যাওয়া ভোরের শিশির  

জোনাকির নিয়ন আলো

কবিতার ছন্দ মাত্রা অক্ষর 

তুমি তারার শহরে নীল প্রজাপতি

ভেঙে যাওয়া নূপুরের উত্তাল ঢেউ 

তুমি অনুভূতির স্নিগ্ধ সুভাস


কাশফুলের নরম ছোঁয়া হৃদয় 

মেঘেদের শহরে বৃষ্টির লুকোচুরি 

আড়ালে দাঁড়িয়ে দেখে যাও 

পাখিদের ঘরে ফেরা সুখ

তুমি মুছে যাওয়া তারাদের একজন ।।


© 

রবিবার, ২৪ ডিসেম্বর, ২০২৩

তমাকথন শফিক নহোর

 





সাত সকালে হাসিটা ফ্যাঁকাসে হয়ে ঠৌঁটের কিনারে — ঝুলে থাকলো, কোন ভাবেই বনলতাকে কথাটা বলা হলো না।

কিছু মানুষ আছে,শামুকের মত যত-ই কাছে যাওয়া যাবে নিজেকে ততটাই লুকিয়ে রাখে ‘‘তারা এক ধরনের মিসকা শয়তান।’’ উপরের লেবাস দেখে মনে হবে মক্কার খেজুর।'বাস্তবিক শয়তানের হাড্ডি। পেটের ভেতর কথা জমা রাখতে পারেনা র্স্বনা,তার পরেও বাধ্য হয়ে জমা রাখতে হয়। ঘরের আয়নার সামনেই মনে হয় নিজের লাশ ঝুলে আছে। 

মাকে কথা গুলো বলা হলনা, বললে নিশ্চয়ই মা 'চালে ডালে মিশিয়ে খেচুরি বানিয়ে দিতেন। মা' আগের দিনের মানুষ হলেও এ যুগের আধুনিক ফেসবুক ব্যবহারকারি। মাকে কোনকিছু লুকাতে হলে অসীম, জ্ঞানের অধিকারী হতে হবে। সকালে উঠে এক গাদা কাজ। দাঁত ব্রাশ কর, মুখ ধোও, বাথরুমে য়াও, চুল চিরনি কর, মুখে ফ্রেশ ওয়াশ লাগানো। সাজ গোঁজ না করলেও এটা করতে হয়। এটা হল মেয়ে মানুষের এক ধরনের ধর্মলয়। মা' ‘ঘুম থেকে উঠে আজ কি রান্না হবে কী করতে হবে কত কি?'

বাবার পেছনে তো পাঁচ ছয়জন থাকেই এ পরিবারটাকে কেউ প্রথম — দেখলে মনে করবে রাজপরিবার। কোন এককালে আমার বাবার দাদারা এদেশের জমিদার বংশের কেউ ছিলেন। রাজনৈতিক দিক দিয়ে আমাদের পরিবারের পরিচয় অনেক বড়। দাদা, দীর্ঘদিন এলাকার চেয়ারম্যান,শিক্ষা অনুরাগী দানশীল সমাজ সেবায় নিজেকে জড়িয়ে নিয়েছিলেন নিবিড় ভাবে। এ সমাজে মানুষকে দিয়ে, খাইয়ে কোন নাম নেই। সব কাকের জাত !’ এক ঢালে খাবে, অন্য ঢালে ঠিকই মুখ মুছবে। ‘দো-ঘরের মাসি।' মা মেয়ের ঝড়-গা দেখলে মনে হয় গৃহযুদ্ধ, এটা-কে করেছে,আমার জিনিস অন্য মানুষ হাত দিবে কেন?

নিজের বোন তার হয়েছে দু’চোখের জ¦ালা। বনলতা ছাড়া কেউ তার জিনিসে এ হাত দেয়না। আপন দুই বোন হলেও নিজেদের ভিতর সার্বহ্মনিক বিরোধী দলীয় মন ভাব। কেউ কাউকে ছাড় দিবেনা। নিজের প্রতি অটল,অবিচল, অনড়। নিজের স্বার্থে একটু আঘাত লাগলে তৈল এ— বেগুনে জ্বলে উঠবে ।‘আল্লাহ মানুষকে সম্পদ দেয় তার ঈমানি পরীক্ষার জন্য হয়তো রূপ ও দেয় বিশেষ কোন পরীক্ষার জন্য। আজকাল গর্ব ধারিণী মা-ও তার চোখের কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে। কোন ভাবেই মাকে সহজ ভাবে মেনে নিতে পারে না। নিজের প্রতি নিজের-ই ঘৃণা হয় এমন একটা পরিবারে আমার জন্ম হয়েছে। নিজের মনের বিরুদ্ধে নিজেকে আপন মানুষ থেকে নিজেকে আড়াল কওে রাখতে হয় নিজের ভালোর জন্যই। 

কিছু মানুষ আছে যাদের জন্য অন্তর হু হু করে কেঁদে ওঠে। কিন্তু তাদের সাথে রক্তের কোন-ই সম্পর্ক নেই আত্মীয়তার বন্ধন নেই, তবুও মনে হয় সে আমার পরম আত্মীয়। কারো কারো জন্য উৎকণ্ঠ থাকি কারো যদি কিছু হয়ে যায়। শুধু আমি-ই আমার পরিবার পরিজনদের কাছে আপন হতে পারিনি। এটাই সত্যি "যে মানুষ পরিবার-পরিজনদের কাছে যে প্রিয় হতে পারে না সে দুনিয়ার কোথাও প্রিয় হতে পারে না। আর এটাই বাস্তব। তার পড়েও সমাজ সংসার এ চলতে হলে। কখনো কখনো আপনকে পর,পর কে আপন এভাবেই চলতে হয়। মানুষ চলছেও তাই। কিছু মানুষ পরিবারের না হলেও অন্তরের ভেতারকার। অনেক কাছের আত্মীয়তা আছে যাদেরকে দেখলে আমি চিনতে পারবো না। সে কি সত্যিই আমাদের আত্মীয় কিনা? এ রকম হয়তো অনেক মানুষের জীবনেই আছে। কাছের মানুষ গুলো অনেক অনেক দূরে।


তার পরেও স্বপ্ন দেখি আজ এবং আগামীর পৃথিবীর সব মানুষের সাথেই আমার সুসম্পর্ক .... ! শুধু আমার মা ছাড়া। সব মা-ই মা, হতে পারে না। সব মা-ই সব সন্তানের কাছে প্রিয় হতে পারে না। সব সন্তান-ই মায়ের প্রিয় সন্তান নয়। যেমনটি আমি । আমি চাই আমার মা -জয়ী হোক আমার মায়ের মনের সকল 

আশা পূর্ণতা পাক। মা হয়তো মনে মনে চায় আমি মরে যাই, আমার কোন কিছুতেই যেন সফলতা না আসে। হয়তো এটাই সত্যি! এমনও হতে পারে, হয়তো এটা আমার মনের ভুল ধারণা। মায়ের সাথে মাঝে মধ্যেই তুমুল অকারে ঝড়-গা হয়ে য়ায় কারণে-অকারণে।


- নিলুর মায়ের কাছে আমি একদিন গোপনে শুনেছি, মা আমার অজান্তে অনেক বার চোখের জল বিসর্জন দিয়েছে। আমার মনে হয় ওটা ছিল মায়ের সাজানো কোন নাটক। কারণে-অকারণে মাকে অনেক কথা বলেছি, এ জন্য সত্যি কোন সময় অনুতপ্ত বা নিজের কাছে দগ্ধ হইনি। আমার মা তো মুখোস ধারী একজন মানুষ। 

নুরজাহান বেগমকে প্রতিদিন শুনতে হবে হাজারটা কৈফিয়ত। আবার জবাব ও দিতে হবে মেয়ের কাছেই। এ যেন ঝিয়ের পেটে মায়ের জন্ম।

-সকালে চা আনতে এত দেরী হল কেন ? 

-নিলুর মা!

-তুমি জানো না?

-সকালে চা না খেলে আমার মাথা ঠিক থাকেনা।

একটা কথা তোমাদের কয়দিন বলতে হয়?

নিলুর মা, বিচারী ভয়ে কোন কথা না বাড়িয়ে চুন্নি বিলাই-এর মত পাশ কেটে চলে গেল। 

-র্স্বনা, একটু বিরক্ত হয়ে মুখ কালো করে বললো — তোমাদের পুষ্প মাল্য দেওয়া উচিত। এ বাড়িতে কে যে তোমাদের কাজ দেয়। রাজ কন্যার মত চা পান শেষ করলো। বসে দাঁড়িয়ে কোন ভাবেই- শান্তি পেলনা অবশেষে চায়ের কাপটি বিরক্তি হয়ে পাশের টেবিলে রাখলো। তারপর 

রুমের এ পাশ থেকে ওপাশে পায়চারি শুরু করল। স্থির হয়ে বসে থাকতে পারছে না কোন ভাবেই। মেয়ে মানুষ একটু সন্দেহ প্রবণ খুব। কী যেন একটা লুকাতে চাইছে স্বর্ণা, শাক দিয়ে মাছ ঢাকার মত। চোরের মন পুলিশ- পুলিশ।


নুরজাহান বেগম ধীর গতিতে সামনের দিকে অগ্রসর হয়ে আসছেন। মেয়েকে উদ্দেশ্য করে খুব মমতা মাখিয়ে বলল,

-কী রে স্বর্ণা কিছু বলবি কী আমায়।

-মা,আমার ঐ জলপাই রঙের ড্রেসটা কি তুমি তুলে রেখেছো? 

মাএকটু ঠোঁটের কিনারে ডিপলিকেট হাসি এনে মিষ্টি সুরে বললো, কোনটা রে  

আমার জিনিসের কথা কী তোমার মনে থাকে। বড়মেয়ে হলে তো ঠিকই মনে থাকতো।

 থামলি কেন ? ‘বল শুনি?'  তোমার কি খুব শখ হয়েছে এখন বড় মেয়ের গল্প শোনার জন্য।  তোমাদের আচরণে মনে হয় তোমারা কেউ আমার ভালো চাও না। কেউ মন থেকে ভালোও বাসোনা। তোমাদের সব কিছুই তো তোমাদের বড় মেয়ে। বড়মেয়ে ছাড়া এটা হবে না সেটা করব না। বড় মেয়ে নেই,আজ মাছ রান্না করবো না। ও তো তোমাদের মেয়ে না তোমাদের অন্ন দাতা। এ বাড়িতে কোনকিছু তার ছাড়া হয় বল মা? 

নুরজাহান বেগম অনকেটাই থমকে গলেনে। ভিতরে ভিতরে খুব জ্বলছে। এটা আমার মেয়ে না দুমুখো সাপ তার পরও মা বলে কথা। 

অভিমানী কণ্ঠে নুরজাহান বেগম বলল, 


-তুই ও একদনি মা হবি ?' সেদিন বুঝবি। তোকে বেশি ভালবাসি তো তাই।

র্স্বণা, জানালে দিয়ে উঁকি মেরে দেখল তার পরে কন্ঠের স্বরটা একটু বাড়িয়ে দিয়ে বলল,

-'আমার ড্রসটা তোমার বড় মেয়ে নিয়েছে হয়তো। না হলে যাবে কোথায় ?'


-ওকে আমি সব দেখছি।

 -‘তুই গিয়ে দেখ তোর বাবার শরীরের জ্বরটা এখন কেমন?  শোন-উপর তালা থেকে একটু দেখে আস। আমি ডাক্তারকে কল দিবো আসার জন্য। 

দু'হাত মাস্তানদরে মতো চুলরে ভিতর দিয়ে, চুল গুলো ঠিক ঠাক করে নিলো র্স্বণা, কণ্ঠে একটু মমতা নিয়েই বলল,

- ‘যাচ্ছি মা' 

মেয়েরা সাধারণ তো বাবা ভক্ত হয়। বাবা ও মেয়ের ভক্ত হয়। আবার সব বাবা-ই মেয়ের ভক্ত হয় না। সিঁড়ি বেয়ে রেলিং ধরে উপর তলায় উঠছে র্স্বণা, পায়ের শব্দ বুঝতে পারছে বাবা। অনকে পুরনো বাড়ী আগে তো রেলিং দেওয়া ছিলনা। এতো খাড়া সিঁড়ি নতুন কেউ উপর তলায় উঠতেই ভয় পেয়ে যাবে। পুরাতন দিনের মানুষের কামকাজ এত কঠিন ছিল কেন ? না কি আগের মানুষ পাগল ছিলো। একা একাই বিড়বিড় করতে লাগলো।

-বাবা তুমি কেমন আছো ?

-কে র্স্বণা ?

মাথা নেরে জবাব দিল হ্যাঁ স‚চক র্স্বণা। 

-কী রে, মা তোর কী ? আজ মন খারাপ ! 

-না বাবা, মন খারাপ হবে কেন?


-তোমার শরীরের কী অবস্থা। কেমন লাগছে এখন বাবা।

 একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস নিয়ে বলল,

- অনকেটা ভালো। পরম মমতা নিয়ে বাবার কপালে হাত দিয়ে ডাক্তারদের মতো দেখতে লাগলো আমার মেয়ে। মেয়েদের ভিতর মায়া মমতা কাজ করে একটু বেশি। সত্যি কথা কী শেষ বয়সে ছেলের বউয়ের চাইতে মেয়েরা বাবাকে খেয়াল রাখে বেশি। আমার মেয়ে এত খেলাল রাখবে, ও কে দেখে মনে হয় আমি ওর সন্তান। বাবা এটা করা যাবে না, এখন এটা খাবে না। আমার আবার কোক এর —

প্রতি একটু লোভ বেশি! খাবার শেষে কোক না হলে কী জমে।

-র্স্বণা, বাবা তোমার না এখন ও অনেক জ্বর শরীর পুড়ে যাচ্ছে পানি দিতে বলব কি?

-না রে, মা' লাগবে না।

-তোর মাকে বলল, মজিদ ডাক্তারকে আসতে। পেশার একটু চেক করে দেখা দরকার।

কামাল পাশা রাজনতৈকি নেতা,থানা পর্যায় এমন কেউনেই যে, তাকে চেনেনা। সারাদিন একের পর এক ফোন আসতইে থাকে। এ নিয়ে বেশ ক'য়েক দফা ঘরের বউয়ের সঙ্গে ঝড়-গা হয়ে গেছে কামাল পাশার। অসুস্থ শরীর নিয়ে সারাদিন অন্য নেতা র্কমীদরে সাথে কথা বলবে। এটা কোন ভাবইে সয্য করবে না। নুরজাহান বেগম।


-‘বউ না ডাকু বোঝা বড় দায়, নুরজাহান বেগম শেষ বয়সে এসে লেখাপড়া শেষ করছেনে একটি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। বই পড়ার প্রতি তার খুব নেশা, এক কথায় বলা যায় বইপোকা একজন মানুষ। অনকে নামি দামী লেখকের বই তার সংগহে কোন এক সময় স্বপ্ন দেখত গ্রামের হাইস্কুলে মাস্টারি করবে,তা আর হয়ে ওঠেনি। তার পিছণে সে অনেক কথা, বিয়ের পরের বছরে বড় ছেলে জন্ম নিলো, তার পরে নতুন সংসার, লেখাপড়া তখন শেষ হয়নি। অনেক স্বপ্ন কবর দিয়ে রাখতে হয়েছে সংসারে।


-‘মানুষরে জীবনে সব চাওয়া পাওয়া-ই সব সময় পরিপ‚র্ণতা পায় না। কিছু-কিছু পরাজয় মেনে নিতে হয় আপন জনদরে কারণণে।

নুর-জাহান বেগম, সম্ভান্ত পরবিাররে মেয়ে, মেট্রিক পাশ করে সবে মাত্র কলজে ভর্তি হয়েছিল। তার কিছুদিন পরইে বিয়ে হয়ে যায়। নানি, ছোট খালা, মা' কত করে -নুরজাহান কে বুঝিয়েছে বিয়ের জন্য। অনকেটা নিজের ইছার বিরুদ্ধে বিয়ে করে ছিল। শুধু মাত্র বাবার সম্মানের দিকে তাকিয়ে। এ যুগের মেয়ে হলে ......!

আগের দিনের সব কিছুই ভালো ছিল। মানুষ,সমাজ সংসার, পরিবেশ। এখন আমারা নিজেরাই এ সব খারাপ করছি। ‘আগের চাইতে মানুষ অনেক শিক্ষিত হয়েছে কিন্তু সভ্য হয়েছে ক'জন।'


আসছে .... 


মঙ্গলবার, ১৯ ডিসেম্বর, ২০২৩

সঙ্গমসুখ ।। শফিক নহোর







চোখ বুজে মাছেদের প্রেমময় সঙ্গম দেখি
জলের ভেতর ডুব দিয়ে পাড়ি দেই সমুদ্র
চোখের ভেতর জলপদ্মের নৃত্য
ঢেউ এসে ভাঙিয়ে দেয় সঙ্গমসুখ ।

বুধবার, ১৩ ডিসেম্বর, ২০২৩

পোড়ামাটির ঘ্রাণ || শফিক নহোর




ক.

কামারহাটের বাতাসে একটা গোপন খবর ইদানীং ঘুরে বেড়াচ্ছে। তা নিয়েই মানুষ কানাঘুষা করছে, জোয়ারের পানি বাড়ার সঙ্গে-সঙ্গে বাতাসের বেগও বাড়ছে। পদ্মার-ঢেউয়ের আঘাতে বাহির বাড়ির ঠাকুরঘর ভেঙ্গে যাবার উপক্রম। ভগবানের নাম জপতে জপতে এ যাত্রায় ঠাকুর রক্ষা করেছে। তা না হলে গাঙের জলে পতিমার মতো নিজেও বিসর্জন হয়ে যেতে হতো এতদিনে। মন্দির রক্ষা করবার জন্য উপজেলায় কাগজ পত্র জমা দিয়েছে পোদ্দার সাহেব। তা কোন কাগজের নিচে চাপা পরে আছে কে জানে।নিজের ব্যবসা বাণিজ্যের খোঁজখবর নিতে পারছি না ঠিকঠাক মতো। টাকা ছাড়া কি কোন কাজ হয়। আজ ক'দিন নিজের শরীর ভাল যাচ্ছে না বলে নিমাইকে পোদ্দার তার মনের দুঃখ প্রকাশ করছে।

──জানিস নিমাই 'সব মানুষই গু খায় দোষ হয় ঘাইরা মাছের।' টাকা পয়সা দিয়েও তো নদী ভাঙন রোধ করতে পারছি না গ্রামের মানুষ সহজ সরল, নেতারা যা বলে তাই বেত, বাইবেল।সত্য কথা হল সবি চোর।
বিশু পোদ্দার দানবীর, গ্রামের মানুষের হৃদয়ে তাঁর নাম খোদাই করে লিখে রাখছে; পরের ভালো আজকাল মানুষ সহজে সহ্য করতে পারে না। কত বার ফিকির-ফন্দি করে রাতে পোদ্দার বাড়িতে ডাকাতি করেছে, ফটিক সরকার ও নিমাই। মানুষের জীবন সবচেয়ে আলাদা জীবন। পশু-পক্ষীর মতো না, দিন এনে দিন খাওয়া। মানুষের জীবনে সংসার আছে, ছেলেপেলে আছে। বাড়তি চিন্তা আছে, ভবিষ্যতের জন্যে কিছু জমাতেই হবে। না হলে শেষ বয়সে ছেলেপেলের উপর চেয়ে থাকতে হবে। পুরুষ মানুষের কাজকর্ম করতে লজ্জা কিসের? সৎ ভাবে বেঁচে থাকলেই হল। এই ভাবনা হলো মনস্তান্তিক ভাবনার বহি:প্রকাশ মাত্র।

──নিমাই, লক্ষ্য করেছিস? রীতার বিষয়টা নিয়ে গ্রামে কু-কথা ছড়িয়ে পড়ছে।
── রাম রাম, এসব কথা মুখে আনাও পাপ।হিন্দুদের ক্ষতি করে সরকার বাড়ির মানুষ এখন সাধু সাজছে, যুদ্ধের সময় পোদ্দার বাড়ির সয়-সম্পত্তি জোর করে লিখে নিছে। স্বর্ণালংকার নিয়েছে। তা দিয়ে শহরে ফুটানি করছে। গাড়ি,বাড়ি করে চাষার লেবাস খুলে অফিসার হয়েছে। বছরে একবার বাড়ি আসবে। বড়ো চার পাঁচটা ষাঁড় কোরবানি দিলে বাড়ির পথে কুত্তার মতো মানুষ লাইন ধরে দাঁড়িয়ে থাকবে, তারা মনে করে গ্রামের গরীব মানুষ তাদের দেবতা মনে করে। ভেতরে ভেতরে ঘৃণা করে। তাদের মুখে এখন কত কথা শোনা যাবে তারা মূলত সাধু সেজেছে প্রকৃত সাধু না।

── নিমাই, মন্দ বলিস নাই। তুই তা হলে যা, পরে আলাপ করবো। বক্কার মিয়ার সঙ্গে দেখা হলে বাড়ির পর আসতে বলিস। হারাম জাদা আমার সঙ্গে দেখাই করছে না । পাটের গদিতে আজ কদিন যেতে পারছি না।
── কাকা শুনলাম,বক্কার মিয়া বিয়ে করছে?
── হুম, আমাকে তো তাই বলেছিল।
রীতা মোসলমান ঘরের মেয়ে, তার একটা দোষ বের হলে আমাদের সমাজের জাত যাবে। হিন্দু হোক মোসলমান হোক সে তো আমার প্রতিবেশী। বক্কার রীতাকে বিয়ে করলে করুক। বক্কার ছেলে হিসাবে সহজসরল,ধর্মভীরু। বিয়ের জন্ন্যিই তাহলে আজ দুদিন বাজারে আসছে না । বাজার সদাই করতেও তো একজন মানুষ দরকার। গরীব মানুষ এতো বিয়ে করবার শখ জাগে কেন? পুরুষ মানুষের আসলে বদঅভ্যাস একবার জড়িয়ে পড়লে নেশার মতো অতো সহজ ভাবে বের হয়ে আসা কঠিন নারী জীবন থেকে।
── বিয়ে কি বদঅভ্যাসের কারণে করে দাদা?
──তা না হলে কি?'
──বক্কার মিয়া, সকালে নতুন বউয়ের সঙ্গে ভাত খাওয়া নিয়ে ঝগড়া শুরু করে দিয়েছে, আপনার এখানে আসার পথে শুনে এলাম।
──নিমাই, তা কি জন্ন্যি বাড়ির পর আসছিস কিছু তো বললি না।
── আমার হাজার পাঁচেক টাকা হাওলাত দিলে বড় উপকার হয় দাদা। সামনের সোমবারে নাজিরগঞ্জের হাটে ধান বিক্রি করে টাকা দিয়ে দেবো।
── ভাল কথা মনে করেছিস, সামনে দূর্গাপূজো, খই, মুড়ির জন্য এক মণ ধান আমার বাড়িতে পাঠিয়ে দিস। তুই বাজারে গিয়ে আমার কথা বলিস, কুঠিতে ক্যাশিয়ার থাকে তাকে কাগজ লিখে দিচ্ছি তোর টাকা দিয়ে দিবে।

── বিশু পোদ্দার কোন মানুষকে কখনো খালি হাতে ফিরিয়ে দিয়েছে, এমন কথা মানুষের কাছে শোনা যায় না। যখন যে কাজের জন্য মানুষ গিয়েছে, কাউকে খালি হাতে ফিরিয়ে দেয়নি। সে বছর উদয়পুরের মিয়া বাড়ির লোকজন বাঁশ নিয়ে গেল চার ভ্যান মাদ্রাসা না-কি জালসার জন্য পরের দিন দেখলাম। গোয়ারিয়ার হাটে কার্তিক পাল সেই বাঁশ কিনে নিয়ে যাচ্ছে। দলীয় লেবাস লাগিয়ে গ্রামে দেখছি কেউ কেউ রাজপ্রসাদ গড়ছে। মানুষ অমানুষ দেখে চেনার উপায় নেই এখন।
পোদ্দারের পাটের কুঠিতে সকাল থেকে সন্ধ্যা অবধি কাজ করে যে টাকা পায় তা- দিয়ে সংসার চালানো কঠিন। বক্কারের বাপ একসময় নৌকা চালাতো, বয়স্ক মানুষ শরীরে কুলায় না। ছেলের সংসারে বসে খাওয়া ছাড়া কোন উপায় নেই । বক্কারের মা গখেন সাহার বাড়ি ঝির কাজ করে, কীর্তন পূজা, অথবা বিশেষ কোন বড় আয়োজন হলে বাড়তি খাবার বেচে থাকলে বাড়ি নিয়ে যায়। বক্কারের বাপের জন্ন্যি, তার ভালোবাসা চোখে পরবার মতো। গবীর মানুষের সখ-আহ্লাদ বলতে আর কি পেটে চারটা পানি ভাত পড়লেই হয়। সারাদিন খাটনির কাজ করা লাগে। কাপড় ছেটো হলে যেদিকে টানা যাবে সেদিক থেকেই শরীর দেখা যাবে। গরিব মানুষের সংসারে অভাব থাকবেই । সকাল বেলা চলে শুধু এক গেলাস পানি খেয়ে, দুপুরে ঢেঁকিতে ধান ভানলে কুলার উপর কয়ডা চাল ঝেড়ে মুখের ভেতর দিয়ে চিবিয়ে দুপুর পার করা। সাঁঝের সময় সমস্ত কাজ শেষ করে খেগেন সাহার বউ শাড়ির আঁচলে খুদ, অথবা চিটা ধানের বাড়া দিলে বাড়িতে এসে চুলায় চুড়িয়ে তা লবণ মরিচ দিয়ে অথবা কোন কোন দিন পেঁয়াচ-মরিচ ছেনে রাতের খাবার খেয়ে স্বামী সন্তান নিয়ে শুয়ে পড়ে বক্কার মিয়া।
খ.

পোদ্দার বাড়ির শান বাধানো ঘাটে গোসল করবার পর ভেজা কাপড় শরীরে পেঁচিয়ে বাড়িতে যাওয়া একটু কষ্ট হয়, এই শীতের দিনে রীতার।
── কি গো বক্কার মিয়া, তোমারে বললাম পোদ্দারের কুটির থেকে আমার সঙ্গে ঢাকায় চলো গেলে না। শুনলাম,বউ বাচ্চার খাবার দিতে পারছো না, সংসারে অভাব বাড়ছে। ছেলে-মেয়ে অসুস্থ তার উপর তোমার বাপ,তোমার ঘারে চাপছে।
── নিমাই কাকা, আমি মূর্খ মানুষ। ঢাকা গিয়ে কি করবো, ঢাকা না-কি অনেক মানুষ থাহে সবাই টাকা পয়সাওয়ালা মানুষ।
── ধুর বেটা, ঢাকার শহরে তোর চেয়ে ফন্নি মানুষের অভাব নাই। তোর ত চরিত্র ভাল আছে, শহরে বিভিন্ন এলাকায় বদ-চরিত্র মানুষ এসে বস্তী বানায় ফেলছে। খারাপ ভালো সবি আছে শহরে। তোর বউ সকালে পোড়া মাটি খায়, ভাত খেতে পায় না। এ কথা একজনের কাছ থেকে গ্রামের সবাই জানে। তোর বউরে দেখতে আসে। মানুষ মুখের সামনে কিছু বলে না। পিছনে মজা নেয়। মানুষ জাতটাই এমন বেহায়ার মত। কেউ উপকার করতে পারলেও করবে না। এখন মানুষ সবচেয়ে বেশি ভয় করে মানুষকে বনের বাঘের চেয়ে বেশি। তুই আমারে বিশ্বাস করলে, তোর জন্যি কথা বলতে পারি।
── নিমাই কাকা, রীতা সকালে পোড়া মাটি দিয়ে দাঁত ঘষতে-ঘষতে অল্প অল্প করে খাওয়া শিখে গেছে। আমি যেমন বিড়ি খাই, বিড়ি না টানতে পারলে মাথা ভার ভার লাগে। আমার বউ পোড়া মাটি না খেলে ওর না-কি ভাল লাগে না। একটা কিছু খেয়ে বেঁচে আছে তাতেও মানুষের কত কথা।' নিমাই কাকা, তুমি যাও তোমার লগে পরে কথা কবোনে।

মনে মনে কি যেন ভাবতে থাকে বক্কার মিয়া, বউয়ের শরীরটা ভাল না। ভাবছি,কবিরাজ বাড়ি নিয়ে যাবো। পরনের কাপড় খানা প্রায় ছিঁড়ে গেছে, পথের লোকজন বউয়ের শরীরের দিকে চাইয়া থাহে। লাজ শরম কিচ্ছু নাই। সংসারের কোন আয় উন্নতি নাই। সারা জীবন পরের বাড়ি কাজ করেই গেলাম। বউরে কোনদিন এক জোড়া কাঁচের চুড়ি কিনে দিতে পারলাম না। নিজের মনের ভেতরে আফসোসের ঢেউ গড়াগড়ি খায় বক্কার মিয়ার মনে। বক্কার মিয়া ঘরের ভেতর ঢুকতেই তার বউ বমি করতে করতে উঠোনে চলে আসলো। কুয়া থেকে পানি তুলে বউয়ের মুখে, মাথায় দিতেই মাটিতে শুয়ে পড়ল। সারাদিন কিছু খায়নি তার মেয়ে ভাঙা ভাঙা কণ্ঠে বলছে,
── বাজান আমিও মায়ের সঙ্গে মাটি খাওয়া শিখে গেছি।
বক্কার মিয়ার চোখ ভিজে ওঠে মেয়ের কথা শুনে। পদ্মাপারের সমস্ত পানি চোখের ভেতরে পোড়া মাটি হয়ে ঢেউ খেলে। পাখির কিচিরমিচির শব্দ, তার কাছে তখন নরক যন্ত্রণার মতো মনে হয়। ভোরবেলা থেকেই গাছের ডালে কাকপক্ষী ডাকছে । তখন থেকেই মনে হয়েছিল আজ একটা খারাপ কিছু হবে। মনের ভেতর মানুষ নিজে নিজে যত কথা বলে সেই কথা আর কখনোই মানুষের সঙ্গে বলা হয়ে উঠে না । মানুষ নিজের সঙ্গেই কথা বলে বেশি।
── বউরে আমার দিকে একটু দ্যেখ।
রীতার চোখ গুলো কেমন ফ্যাঁকাসে হয়ে গেছে। মুখ মলিন হয়ে পরে আছে মাটিতে। কথা বলছে না, মনে হয় জ্ঞান হারিয়ে ফেলছে। নাক দিয়ে মৃদু বাতাস বের হচ্ছে, দাঁত লেগে আছে। ঘর থেকে পানের বোটা নিয়ে এসে যেই রীতার কানের ভেতর দেওয়া হলো। সঙ্গে সঙ্গে নড়াচড়া দিয়ে উঠে পড়ল। স্বামীর মুখের দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ। বাড়ি ঘরের দিকে কেমন তাকিয়ে রইল। ভাব চক্কর দেখে মনে হচ্ছে রীতা এ বাড়িতে নতুন এসেছে। বউ বাচ্চার দিকে তাকালে মায়া করে।
নিমাই, বক্কারের বউয়ের অসুস্থতার কথা শুনে দেখতে এসেছিল। রাক্ষস চোখে নিমাই কাকার মুখের দিকে চেয়ে রইল খানিকক্ষণ রীতা।

নিমাই কৌশল করে বলছে,
── বক্কার তোর বউয়ের জন্য ডাব নিয়ে এসেছি, তারে ডাবেব পানি খাওয়া, হাকিম কবিরাজের কাছ থেকে একটু তেল পড়া নিয়ে এসেছি। মাথায় দিয়ে দে, ঠিক হয়ে যাবে।
কথা গুলো কেমন যেন রীতার শরীরে গিয়ে তীরের মতো বিঁধল। সে বুঝতে পারত নিমাই কাকার দৃষ্টি ছিল তার শরীরের দিকে।
রীতা জোড়ে চিৎকার করে বলল,
── এই ডাকাত আমাগো বাড়িতে ক্যান। পোদ্দার বাড়ির তা খায়ছে নিমকহারামি,
তাকে দেখেই আমি চিনছি। সেই তো ফটিক সরকারের সঙ্গে ডাকাতি করে রাতের বেলায়।
বক্কার ওঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে নিমাই অদৃশ্য হয়ে গেল।


শনিবার, ৯ ডিসেম্বর, ২০২৩

শফিক নহোর ।। ছোটগল্প ।। গয়নার নৌকা



অপ্রত্যাশিত ভাবে মুন্নির সঙ্গে আমার ফিজিক্যাল রিলেশনশিপ গড়ে ওঠে। তার পর থেকে মুন্নি আমাকে খুন করার জন্য লোক ভাড়া করে। আমি ফেরারি আসামির মত পালিয়ে বেড়াতে লাগলাম। ঘরের ছোট ছিদ্র দিয়ে আলো আসলেও ভয় করতো কেউ বুঝি আমাকে দেখে ফেলল। এই ভয়কে উপেক্ষা করে একদিন বৃষ্টি-ভেজা দুপুরে মুন্নি আত্মহত্যা করেছে শুনে দৌড়ে গেলাম।

 

আমি তখন নানা বাড়ি থেকে লেখাপড়া করি। মুন্নি আমাকে ভয় দেখাত, আমাকে বিয়ে না করলে বড় মামার কাছে বিচার দেবো?’ আমার সামনে এসে কথা কখনো বলেনি। তবে সালমা আমাকে বলত, কিরে মুন্নিকে নাকি তুই বিয়ে করবি, আমার কাছে বল না সত্যি কথা। সালমার আবদার ছিল ভিন্ন রকম।আমি সালমার চোখের দিকে তাকিয়ে থাকতাম। এই তাকিয়ে থাকাটা অন্যায় কিছু না সুন্দর চোখের দিকে তাকিয়ে থাকা যায় অনন্ত একশ বছর। ছুটির দিনে চরদুলাই বটগাছের নিচে বসে আছি। আমি গয়নার নৌকায় পাড় হবো। বাড়ি থেকে খবর এসেছে মায়ের শরীর ভালো না। বড় মামা আমাকে প্রায়ই বলতো,

-সেলিম তোকে কিন্তু ডাক্তার হতে হবে।

আমি মামার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকতাম; তালা ঝুলানো আমার মুখ থেকে কোন শব্দ বের হতো না। মামার কথা শুনে আমার চেহারা ম্লান হয়ে যেত; আমি বাণিজ্য-বিভাগ নিয়ে লেখা পড়া করছি, আমার দিন কাটে ডেবিট-ক্রেডিট চূড়ান্ত হিসেব নিয়ে। ডাক্তার হবো কীভাবে? কি সব ভাবনা ভাবে মামা আল্লাই ভালো জানেন। সেদিন বাড়ি পালাতক শিশুর মত মামার সামনে থেকে সরে দাঁড়ালাম। আমি যে টিনের ঘরে পড়তাম, সেই ঘরের জানাল ছিল না। নতুন ঘর টিন কেটে রেখেছে, জানালা লাগলোর জন্য সেই ফাঁকা জায়গায় শীতের দিনে পাটের বস্তা দিয়ে রেখে দিতাম। যাতে বাহির থেকে কুয়াশা ঠাণ্ডা বাতাস না আসে। একদিন সেই খোলা জানালা দিয়ে ঢুকে মুন্নি আমার মুখ আটকিয়ে ধরল, উষ্ণ আলিঙ্গনে সে আমার বুকের ভেতরে ঢুকে গেল নবজাতক শিশুর মতো। আমি চিৎকার করবার চেষ্টা করলাম। কিন্তু মুখ দিয়ে কোন প্রকার শব্দ বের করতে পারছি না। আমার হাতে হালকা একটা কামড় দিয়ে চলে গেল। অথচ কিছুই বলল না। আমি ফিসফিস করে জানতে চাইলাম,

-এখানে কেন এসেছিস?

 মুন্নি কোন কথা না বলে জানালার ফাঁকা দিয়ে বের হয়ে চলে গেল। আমার শরীর কাঁপছে, কেউ যদি দেখে ফেলে। পরের দিন সন্ধ্যায় বই নিতে এসেছে সালমা, এসে বারান্দার সামনে দাঁড়িয়ে রইল কিছুক্ষণ।

সালমা আমাকে বলল,

-তোর ব্যাকরণ বইখান দে। কাল সকালে দিয়ে দেবো।

 -আমার বই নাই, আমি মুন্নির বই নিয়ে পড়ি।

সালমা কথা না বাড়িয়ে চলে গেল। শূন্য হাতে ফিরে যাবার কষ্ট সবাই অনুভব করতে পারে না দেখা আর তাকানোর ভেতর যোজন যোজন দূরত্ব থেকে যায়। আমরা দেখি অথচ তাকাই না অন্তর দিয়ে কারো দিকে তাকিয়ে থাকলেই অলিক মোহমায়া বাধা পড়ে যায় মানুষ। আঠার চেয়ে মায়ার বাধন হল শক্ত বাধন।কেউ মায়ায় আটকিয়ে গেলে দূরে চলে যেতে পারে না।

 

ছোট মামা বিলে কারেন্ট জাল পেতেছে। কৈ, পুঁটি মাছ পেয়ে কলপাড়ে মাছের বালতি থেকে পানি ঢেলে আবার নতুন পানি দিচ্ছে। আমি একটু এগিয়ে যেতেই সালমা আগ কেটে গিয়ে মুন্নিকে বলল,

-ভালোই তো চলছ, আমি সব জানি।

-জানিস ভালো কথা। সব জানিস তা আমাকে বলছিস কেন? তোর নাঙকে গিয়ে বল।

-খুব জ্বলছে তাই না। বই কিনে নিতে পারিস না।

-পারি কিনব না, তোর কোন সমস্যা? তুই আমার পেছনে লেগে কিছুই করতে পারবি না।

সেলিম, তোকে কোনদিন বিয়ে করবে না।

"নদীর মাছ সাগরে পড়লে যা হয়।'

-এতো ভাব দেখাচ্ছিস কেন রে মাগি।

-তোর চেয়ে কি আমার চেহারা কম সুন্দর!

মুন্নির সালমার ধারালো ছুড়ির সেই কথাবান আমার কানের  সদরদরজায় ঠকঠক কড়া নাড়তে শুরু করল। মনোযোগ না দিয়ে বাহিরে যাওয়ার জন্য রেড়ি হচ্ছি তখন রাজীব এসে বলল,

 -ক্রিকেট খেলা শুরু হয়ে গেছে। তুই এখনো বসে আছিস। দ্রুত রেডি হয়ে নে।

 মাঠ থেকে রাজীব আমাকে ডাকতে এসেছে। রাজীব অভিযোগ করে বললো,

-মাস্টারের ছেলে খেলতে দেবে না। ওরা না কি মাঠের পাশের জমিতে গম বুনছে, খেতের আইলে বল গেলে যে আনতে যাবে তার নাকি ঠ্যাঙ ভেঙে দেবে ?

-বলা সহজ, করা কঠিন। চামড়ার মুখে মানুষ কত কথা বলে। আজকাল কথা বলতে পারলেই মানুষ নিজেকে বীর-বাহাদুর ভাবে।" আসলে সমাজে যাদের কাছে এখন টাকা নেই তাদের কোন দাম নেই, চেয়ারম্যানের ছাওয়াল দলের অধিনায়ক। চল দেখি, কার ঠ্যাঙ কে ভাঙে? সময় হলে সব বিড়াল হয়ে ফিরে যাবে।

 

মাগরিবের আজান হচ্ছে খেলা শেষ। বাড়ি এসে কলপাড়ে হাতমুখ ধুচ্ছি তখন মুন্নি জগ ভরতে এসেছে, আমার পেছনে দাঁড়িয়ে। কোন কথা বলছে না। আমার শরীর ঘেঁসে টিউবওয়েলের হ্যান্ডেল ধরল, আমি বুঝতে পারছি না কি বলবো। আঁধার গাঢ় হতে লাগলো। জগ থেকে পানি নিয়ে হালকা ছিটিয়ে দ্রুত চলে গেল। বুকের ভেতর হাহাকার অনুভব করলাম।

 

 নয় ছয় ভাবনা ভবতেই সালমা চলে আসলো। ওর মুখের দিকে তাকাতেই জগতের মেঘ ওর মুখ জুড়ে ভেসে বেড়াচ্ছে। মলিন চেহারা, ঠোঁটে হাসি নেই, সাপের মত ফুলেফেপে থাকত সে স্বভাব এখন নেই। শান্ত অবুঝ বালিকার মত আমাকে বলল,

- এখন খুব খুশি হয়েছিস তাই না? আমি জানতাম তুই কিছুই বলবি না। তোর সাহস আছে? আমাকে আজ রাতে পালিয়ে নিয়ে যেতে। আমাকে বিয়ে কর, তোকে ছাড়া আমি কাউকে আমার জীবন সঙ্গী হিসেবে ভাবতে পারবো না।

বজ্রগতিতে সে বলে দ্রুত প্রস্থান করলো। সালমার কথা শুনে আমার কান গরম হয়ে গেল। গলা শুকিয়ে আসছে। আমি মাটির দিকে চেয়ে রইলাম,  কে যেন আমার পা ধরে মাটির নিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। সালমার চোখ বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়লো এই মুহুর্তে ঠিক কি বলবো বুঝতে পারছি না। কাঁপা কণ্ঠে জিগ্যেস করলাম।

- তোর কি বিয়ে ঠিক হয়েছে?

- সেটা জেনে তোর কি? তুই তো একটা কাপুরুষ!

মৃদু পায়ে সামনে এগিয়ে গেলাম। বড় মামি বলল,

-জানিস, আগামীকাল সালমার বিয়ে!

- আচ্ছা মামি মেয়েদের কি অল্প বয়সেই বিয়ে দিতে হয়।

- ধুর পাগল, মেয়ে মানুষ কি ঘরে তুলে রাখার জিনিস। ভালো ছেলেপক্ষ পেলেই মেয়ের বিয়ে দিয়ে দিতে হয়। তুই সব বুঝবি না। বুঝিনা বলেই তো আমার মুখের সামনে সালমা কাপুরুষ বলতে পারে? মুন্নির স্মৃতি আমাকে ভীষণভাবে তাড়িত করে, আমাকে অস্থির করে ফেলে। কি এমন ভুল ছিল আমার। এতো তাড়াতাড়ি তার নিজস্ব একটা কালো অন্ধকার ভুবন হবে। তাকে আর কখনো দেখবো না। কথা বলতে পারব না। এই অপরাধ-বোধ আমাকে পাগল করে দেয়। ভেতরের কষ্টটা আমি কাউকে বলতে পারি না। মুন্নি চলে যাবার পর থেকে ছোট মামি আমার সঙ্গে কথা বলে না। অথচ প্রতিদিন রাতে সে আমার জন্য খাবার টেবিলে রেখে যায়। আমি অশ্রুজলে সিক্ত হই। এই বেদনার করুন সুর আমার বুকের ভেতর মুন্নি বলে যে চিৎকার করে ওঠে। তা তো আমি কাউকে দেখাতে পারি না, বলতে পারি না। স্বেচ্ছায় অগ্নিদহনে নিজেকে জ্বালিয়ে অন্তর আত্মশুদ্ধি করা গেলেও বেদনার ক্ষত নিজেরই রয়ে বেড়াতে হয় অনন্তকাল। মুন্নির স্মৃতির সঙ্গে অন্য কারো স্মৃতি আমার জীবনে যুক্ত হোক আমি তা চাইনা। মুন্নি সুন্দর রুমাল সেলাই করত, আমাকে বলেছিল একদিন, তোর নামের প্রথম অক্ষর আর আমার নামের প্রথম অক্ষর দিয়ে রুমাল তৈরি করবো, শেষ হলে তোকে দেবো। আজ অকস্মাৎ পুরনো আলমারি খুঁজতে গিয়ে সেই রুমাল পেলাম। একটি রুমাল এত ওজন হতে পারে আমি হাতে নিয়ে বেশিক্ষণ রাখতে পারিনি। চোখ ঝাপসা হয়ে আসতে লাগল।

আজ সালমার বিয়ে গয়নার নৌকা ঘাটে চলে-এসেছ। পাশের বাড়ির কে যেন সংবাদ দিয়ে গেল।

মামি আমাকে ডাকছে,

-জামাই নামাতে হবে। তোর বড় মামা এই অসময়ে বাজারে গেল কেন? দেখত।

আমি রুম থেকে বের হবো এমন সময় দেখি মুন্নি দাঁড়িয়ে আছে। আমি চিৎকার করে মামিকে ডাক দিলাম। মামি দেখে যাও মুন্নি বাড়ি ফিরে এসেছে।

তার পর আমার আর কিছুই মনে নেই, হেমায়েতপুর থেকে সাতাশ-বছর পর ফিরে এসে দেখি, পরিচিত মুখগুলো নেই। নেই সেই গয়নার নৌকা, আমার মানসিক সমস্যা হয়েছিল। আগের সেই স্মৃতি মনে করতে পারি না। শুধু কিছুক্ষণ পর পর ভেতরে থেকে একটি নাম উচ্চারিত হয় মুন্নি! মানুষ আমাকে এখন পাগল বলে ডাকে।