অপ্রত্যাশিত
ভাবে মুন্নির সঙ্গে আমার ফিজিক্যাল রিলেশনশিপ গড়ে ওঠে। তার পর থেকে মুন্নি
আমাকে খুন করার জন্য লোক ভাড়া করে। আমি ফেরারি আসামির মত পালিয়ে বেড়াতে
লাগলাম। ঘরের ছোট ছিদ্র দিয়ে আলো আসলেও ভয় করতো কেউ
বুঝি আমাকে দেখে ফেলল। এই ভয়কে উপেক্ষা
করে একদিন বৃষ্টি-ভেজা দুপুরে মুন্নি আত্মহত্যা করেছে শুনে দৌড়ে গেলাম।
আমি
তখন নানা বাড়ি থেকে লেখাপড়া করি। মুন্নি আমাকে ভয় দেখাত, আমাকে
বিয়ে না করলে বড়
মামার কাছে বিচার দেবো?’ আমার সামনে এসে এ কথা কখনো
বলেনি। তবে সালমা আমাকে বলত, কিরে মুন্নিকে নাকি তুই বিয়ে করবি, আমার কাছে বল না সত্যি
কথা। সালমার আবদার ছিল ভিন্ন রকম।আমি সালমার চোখের দিকে তাকিয়ে থাকতাম। এই তাকিয়ে থাকাটা
অন্যায় কিছু না সুন্দর চোখের
দিকে তাকিয়ে থাকা যায় অনন্ত একশ বছর। ছুটির দিনে চরদুলাই বটগাছের নিচে বসে আছি। আমি গয়নার নৌকায় পাড় হবো। বাড়ি থেকে খবর এসেছে মায়ের শরীর ভালো না। বড় মামা আমাকে
প্রায়ই বলতো,
-সেলিম
তোকে কিন্তু ডাক্তার হতে হবে।
আমি
মামার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকতাম; তালা ঝুলানো আমার মুখ থেকে কোন শব্দ বের হতো না। মামার কথা শুনে আমার চেহারা ম্লান হয়ে যেত; আমি বাণিজ্য-বিভাগ নিয়ে লেখা পড়া করছি, আমার দিন কাটে ডেবিট-ক্রেডিট চূড়ান্ত হিসেব নিয়ে। ডাক্তার হবো কীভাবে? কি সব ভাবনা
ভাবে মামা আল্লাই ভালো জানেন। সেদিন বাড়ি পালাতক শিশুর মত মামার সামনে
থেকে সরে দাঁড়ালাম। আমি যে টিনের ঘরে
পড়তাম, সেই ঘরের জানাল ছিল না। নতুন ঘর টিন কেটে
রেখেছে, জানালা লাগলোর জন্য সেই ফাঁকা জায়গায় শীতের দিনে পাটের বস্তা দিয়ে রেখে দিতাম। যাতে বাহির থেকে কুয়াশা ও ঠাণ্ডা বাতাস
না আসে। একদিন সেই খোলা জানালা দিয়ে ঢুকে মুন্নি আমার মুখ আটকিয়ে ধরল, উষ্ণ আলিঙ্গনে সে আমার বুকের
ভেতরে ঢুকে গেল নবজাতক শিশুর মতো। আমি চিৎকার করবার চেষ্টা করলাম। কিন্তু মুখ দিয়ে কোন প্রকার শব্দ বের করতে পারছি না। আমার হাতে হালকা একটা কামড় দিয়ে চলে গেল। অথচ কিছুই বলল না। আমি ফিসফিস করে জানতে চাইলাম,
-এখানে
কেন এসেছিস?
মুন্নি কোন কথা না বলে জানালার
ফাঁকা দিয়ে বের হয়ে চলে গেল। আমার শরীর কাঁপছে, কেউ যদি দেখে ফেলে। পরের দিন সন্ধ্যায় বই নিতে এসেছে
সালমা, এসে বারান্দার সামনে দাঁড়িয়ে রইল কিছুক্ষণ।
সালমা
আমাকে বলল,
-তোর
ব্যাকরণ বইখান দে। কাল সকালে দিয়ে দেবো।
-আমার বই নাই, আমি
মুন্নির বই নিয়ে পড়ি।
সালমা
কথা না বাড়িয়ে চলে
গেল। শূন্য হাতে ফিরে যাবার কষ্ট সবাই অনুভব করতে পারে না । দেখা
আর তাকানোর ভেতর যোজন যোজন দূরত্ব থেকে যায়। আমরা দেখি অথচ তাকাই না অন্তর দিয়ে
কারো দিকে তাকিয়ে থাকলেই অলিক মোহমায়া বাধা পড়ে যায় মানুষ। আঠার চেয়ে মায়ার বাধন হল শক্ত বাধন।কেউ
মায়ায় আটকিয়ে গেলে দূরে চলে যেতে পারে না।
ছোট
মামা বিলে কারেন্ট জাল পেতেছে। কৈ, পুঁটি মাছ পেয়ে কলপাড়ে মাছের বালতি থেকে পানি ঢেলে আবার নতুন পানি দিচ্ছে। আমি একটু এগিয়ে যেতেই সালমা আগ কেটে গিয়ে
মুন্নিকে বলল,
-ভালোই
তো চলছ, আমি সব জানি।
-জানিস
ভালো কথা। সব জানিস তা
আমাকে বলছিস কেন? তোর নাঙকে গিয়ে বল।
-খুব
জ্বলছে তাই না। বই কিনে নিতে
পারিস না।
-পারি
কিনব না, তোর কোন সমস্যা? তুই আমার পেছনে লেগে কিছুই করতে পারবি না।
সেলিম,
তোকে কোনদিন ও বিয়ে করবে
না।
"নদীর
মাছ সাগরে পড়লে যা হয়।'
-এতো
ভাব দেখাচ্ছিস কেন রে মাগি।
-তোর
চেয়ে কি আমার চেহারা
কম সুন্দর!
মুন্নির
ও সালমার ধারালো ছুড়ির সেই কথাবান আমার কানের সদরদরজায়
ঠকঠক কড়া নাড়তে শুরু করল। মনোযোগ না দিয়ে বাহিরে
যাওয়ার জন্য রেড়ি হচ্ছি তখন রাজীব এসে বলল,
-ক্রিকেট খেলা শুরু হয়ে গেছে। তুই এখনো বসে আছিস। দ্রুত রেডি হয়ে নে।
মাঠ থেকে রাজীব আমাকে ডাকতে এসেছে। রাজীব অভিযোগ করে বললো,
-মাস্টারের
ছেলে খেলতে দেবে না। ওরা না কি মাঠের
পাশের জমিতে গম বুনছে, খেতের
আইলে বল গেলে যে
আনতে যাবে তার নাকি ঠ্যাঙ ভেঙে দেবে ?
-বলা
সহজ, করা কঠিন। চামড়ার মুখে মানুষ কত কথা বলে।
আজকাল কথা বলতে পারলেই মানুষ নিজেকে বীর-বাহাদুর ভাবে।" আসলে সমাজে যাদের কাছে এখন টাকা নেই তাদের কোন দাম নেই, চেয়ারম্যানের ছাওয়াল দলের অধিনায়ক। চল দেখি, কার
ঠ্যাঙ কে ভাঙে? সময়
হলে সব বিড়াল হয়ে
ফিরে যাবে।
মাগরিবের
আজান হচ্ছে খেলা শেষ। বাড়ি এসে কলপাড়ে হাতমুখ ধুচ্ছি তখন মুন্নি জগ ভরতে এসেছে,
আমার পেছনে দাঁড়িয়ে। কোন কথা বলছে না। আমার শরীর ঘেঁসে টিউবওয়েলের হ্যান্ডেল ধরল, আমি বুঝতে পারছি না কি বলবো।
আঁধার গাঢ় হতে লাগলো। জগ থেকে পানি
নিয়ে হালকা ছিটিয়ে দ্রুত চলে গেল। বুকের ভেতর হাহাকার অনুভব করলাম।
নয় ছয় ভাবনা
ভবতেই সালমা চলে আসলো। ওর মুখের দিকে
তাকাতেই জগতের মেঘ ওর মুখ জুড়ে
ভেসে বেড়াচ্ছে। মলিন চেহারা, ঠোঁটে হাসি নেই, সাপের মত ফুলেফেপে থাকত
সে স্বভাব এখন নেই। শান্ত অবুঝ বালিকার মত আমাকে বলল,
- এখন
খুব খুশি হয়েছিস তাই না? আমি জানতাম তুই কিছুই বলবি না। তোর সাহস আছে? আমাকে আজ রাতে পালিয়ে
নিয়ে যেতে। আমাকে বিয়ে কর, তোকে ছাড়া আমি কাউকে আমার জীবন সঙ্গী হিসেবে ভাবতে পারবো না।
বজ্রগতিতে
সে বলে দ্রুত প্রস্থান করলো। সালমার কথা শুনে আমার কান গরম হয়ে গেল। গলা শুকিয়ে আসছে। আমি মাটির দিকে চেয়ে রইলাম, কে
যেন আমার পা ধরে মাটির
নিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। সালমার চোখ বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়লো এই মুহুর্তে ঠিক
কি বলবো বুঝতে পারছি না। কাঁপা কণ্ঠে জিগ্যেস করলাম।
- তোর
কি বিয়ে ঠিক হয়েছে?
- সেটা
জেনে তোর কি? তুই তো একটা কাপুরুষ!
মৃদু
পায়ে সামনে এগিয়ে গেলাম। বড় মামি বলল,
-জানিস,
আগামীকাল সালমার বিয়ে!
- আচ্ছা
মামি মেয়েদের কি অল্প বয়সেই
বিয়ে দিতে হয়।
- ধুর
পাগল, মেয়ে মানুষ কি ঘরে তুলে
রাখার জিনিস। ভালো ছেলেপক্ষ পেলেই মেয়ের বিয়ে দিয়ে দিতে হয়। তুই এ সব বুঝবি
না। বুঝিনা বলেই তো আমার মুখের
সামনে সালমা কাপুরুষ বলতে পারে? মুন্নির স্মৃতি আমাকে ভীষণভাবে তাড়িত করে, আমাকে অস্থির করে ফেলে। কি এমন ভুল
ছিল আমার। এতো তাড়াতাড়ি তার নিজস্ব একটা কালো অন্ধকার ভুবন হবে। তাকে আর কখনো দেখবো
না। কথা বলতে পারব না। এই অপরাধ-বোধ
আমাকে পাগল করে দেয়। ভেতরের কষ্টটা আমি কাউকে বলতে পারি না। মুন্নি চলে যাবার পর থেকে ছোট
মামি আমার সঙ্গে কথা বলে না। অথচ প্রতিদিন রাতে সে আমার জন্য
খাবার টেবিলে রেখে যায়। আমি অশ্রুজলে সিক্ত হই। এই বেদনার করুন
সুর আমার বুকের ভেতর মুন্নি বলে যে চিৎকার করে
ওঠে। তা তো আমি
কাউকে দেখাতে পারি না, বলতে পারি না। স্বেচ্ছায় অগ্নিদহনে নিজেকে জ্বালিয়ে অন্তর আত্মশুদ্ধি করা গেলেও বেদনার ক্ষত নিজেরই রয়ে বেড়াতে হয় অনন্তকাল। মুন্নির
স্মৃতির সঙ্গে অন্য কারো স্মৃতি আমার জীবনে যুক্ত হোক আমি তা চাইনা। মুন্নি
সুন্দর রুমাল সেলাই করত, আমাকে বলেছিল একদিন, তোর নামের প্রথম অক্ষর আর আমার নামের
প্রথম অক্ষর দিয়ে রুমাল তৈরি করবো, শেষ হলে তোকে দেবো। আজ অকস্মাৎ পুরনো
আলমারি খুঁজতে গিয়ে সেই রুমাল পেলাম। একটি রুমাল এত ওজন হতে
পারে আমি হাতে নিয়ে বেশিক্ষণ রাখতে পারিনি। চোখ ঝাপসা হয়ে আসতে লাগল।
আজ
সালমার বিয়ে গয়নার নৌকা ঘাটে চলে-এসেছ। পাশের বাড়ির কে যেন সংবাদ
দিয়ে গেল।
মামি
আমাকে ডাকছে,
-জামাই
নামাতে হবে। তোর বড় মামা এই
অসময়ে বাজারে গেল কেন? দেখত।
আমি
রুম থেকে বের হবো এমন সময় দেখি মুন্নি দাঁড়িয়ে আছে। আমি চিৎকার করে মামিকে ডাক দিলাম। মামি দেখে যাও মুন্নি বাড়ি ফিরে এসেছে।
তার
পর আমার আর কিছুই মনে
নেই, হেমায়েতপুর থেকে সাতাশ-বছর পর ফিরে এসে
দেখি, পরিচিত মুখগুলো নেই। নেই সেই গয়নার নৌকা, আমার মানসিক সমস্যা হয়েছিল। আগের সেই স্মৃতি মনে করতে পারি না। শুধু কিছুক্ষণ পর পর ভেতরে
থেকে একটি নাম উচ্চারিত হয় মুন্নি! মানুষ
আমাকে এখন পাগল বলে ডাকে।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন