shafiq nohor

বৃহস্পতিবার, ২ মার্চ, ২০২৩

সে আমার কেউ না- শফিক নহোর

 


 

 

ক.

সুমনাকে চুমু দেবার পর। ও আমাকে শয়তান,জানোয়ার তোর সঙ্গে কোনদিন কথা বলবো না । এই কথা শেষ না হতেই ওর চোখ জোয়ার ভাটার মত পানি বইতে শুরু করল,

একটু ঢং স্বভাবে ওর শরীর ঘেঁসে দাঁড়িয়ে আহ্লাদ করে ওর ওড়না দিয়ে চোখের জল মুছিয়ে দিতেই তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠলো। তখন বোঝতে পারলাম ।

সুমনাকে বোঝাতে গেলে বোকা হয়ে যাবো এই মুহূর্তে তার চেয়ে আমি কোন কথা না বাড়িয়ে সদর দরজা দিয়ে বের হতেই মৌ আমাকে দাঁড়াতে বললো। আমি বিদ্যুৎ গতিতে নজর এড়াতে চেষ্টা করলাম।

সুমনাকে এই ক'দিনে আমাকে কল করেনি। আমিও চেষ্টা করিনি। এক ধরনের অপরাধ-বোধ আমার ভেতরও কাজ করছে । তাকে এভাবে এতোটা নিবির সম্পর্কে জড়ানো ঠিক হয়নি ।

আমি রাধানগর শাপলা প্লাস্টিক মোড় পার হয়ে টঙ দোকান থেকে একটা সিগারেট জ্বালিয়ে মৃদুপায়ে হাঁটতে শুরু-করলাম। মনে হলো কেউ একজন আমার সঙ্গ নিয়েছে।

আমি পেছনে তাকাতেই দেখি সুমনা!

 

আবার যেই তাকিয়েছি, সুমনা উধাও হয়ে গেল। না কি কেউ এই মুহূর্তে ওকে গুম করলো কে জানে ? আমি সিগারেটেরে আগুনটা ফেলে দেবো না কি আর একটা টান দেবো দ্বিধাদ্বন্দ্বে পড়ে গেলাম। পাশ দিয়ে রিকসা, ইজি-বাইক, সিএনজি চালিত যানবাহন যে ভাবে চলে পেছনে কেউ একজন আছে কি না বোঝা বড়ই মুশকিল। মোবাইল ফোনের অ্যাপসটা চালু করে দেখে নিলাম । সুমনা সত্যিই কি আমার পেছনে ছিল কি না ?

 হ্যাঁ, সুমনা আমার পেছনেই ছিল তাহলে সুমনা এখন কোথায়?

রিফ্রেশ করে আবার অ্যাপসটি চালু করতেই সুমনার ফোনটি অফলাইন হয়ে গেল। আইকনিক চিহৃ দেখে সেটাই বোঝাতে পারলাম। অথচ আমি বোকার মত ছায়াসঙ্গী হিসেবে সুমনাকে খুঁজছি।

 

 

শহরের শেষের দিকে এসে জরুরি একটা কাজে আবার শহরমুখী হতে হচ্ছে আমাকে। শহরে এখন অনেক আবাসিক হোটেল। কার সঙ্গে কার কি রিলেশন তা দেখছে না কেউ। এর ভেতর দু একজন একটু ভিন্ন। দু’জনের এনআইডি দেখালেই রাত থাকার অনুমতি মিলে যাবে সহজে। এভাবেই পারমিশন ডিসটাইন করে জীবনকে নিজের ইচ্ছের ভেতর নিয়ে আসছে আধুনিক বাবা মায়ের আধুনিক সন্তানেরা। তাদের মেধা নেই, তাদের মাথার ভেতর ঢুকে গেছে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স চরিত্র। সময়কে ধরতে না পারলে সময়ের সামনে দাঁড়ানো যায় না। সেই মেধা যাদের আছে তারা নোংড়ামিতে কখনো প্রতিযোগিতা করবে না ।

 

এখানে সুখ থাকলেও পরিতৃপ্তী নেই । আলোর গতির চেয়ে মনের গতি পরিবর্তন হয় দ্রুত। মানসিক সুখ, টাকাপয়সা, ক্ষমতা, থাকলে এককী চলে আসে । আঁধারে মোড়ানো ক্ষণস্থায়ী সুখের মোহ। জীবনে সুখী হতেই হবে এমন মনোভাব থেকে বের হতে না পারলে সে আসলে সুখী হতে পারে না। সুখী হতে টাকাই লাগবেই এমন কথা নেই। তবে জীবনে টাকার দরকার তা প্রয়োজনের অতিরিক্ত না । অর্থ বেশি হলেই সুখ নষ্ট হতে শুরু হবে ধীরে ধীরে । ঘুণে খাওয়া কাঠের মত ভেতরে ফাঁপা মেরুদণ্ডহীন হয়ে সমাজে দাঁড়িয়ে থাকা কঠিন মানুষ তাকিয়ে দেখবে, পাশে এসে দাঁড়াবে না। দূর থেকে মেকি হাসি দিয়ে দ্রুত বিদায় নিতে ব্যস্ত হয়ে পড়বে। লোকচক্ষুর আড়ালে  ঘোলা জলে ডুব নিয়ে শাদা পোশাক পড়ে আতর মেখে সহি কথাবার্তা বলা লোক সমাজে এখন আগের থেকে অনেক বেশি। ভালোর ভেতর ভালো মিশে গেলে টের পাওয়া যায় না কিন্তু ভালোর ভেতর খারাপ ঢুকে গেলে সঙ্গে সঙ্গে তা যে কেউ বুঝতে পারে।

 

 

রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে ভাবতে ভাবতেই একটি কুকুর ঢ্যাং উঁচু করে প্রসাব করতে লাগলো । জনসম্মুখে জাতে কুকুর তার আবার লাজলজ্জা! মানুষ তার চেয়ে বেহায়া হয়ে দিনে রাতে আবাসিক হোটেলে ঢুকে পড়ছে সুখের নীল দরিয়াতে। কি পাপ কি লজ্জা। সেই অনুশোচনা মানুষের আদৌ নেই।

 

আমি নিজেই তো খারাপ মানুষের দলে। তাহলে আমার ভাবনার ভেতরে এমন সব ভাবনা আসছে কেন?

সুমনা আমাকে এমনভাবে কথাটি বলতে পারলো। শুনেছি, মেয়েদের সয়ে যাওয়া স্বভাব। সেক্ষেত্রে হতেই পারে আমিও বিষয়টা স্বাভাবিকভাবে নিয়েছি। শহর থেকে ফিরতে একটু দেরি হয়ে গেল।

মোবাইল ফোনে তিনটা মিসকল উঠে আছে ।  ফোন কখন যে সাইলেন্ট হয়ে গেছে বুঝতে পারিনি।

 

আজ রাতেই রাতুলের জন্মদিন । আমাকে এমনভাবে বলেছে না গেলে ছেলেটা ভীষণ মন খারাপ করবে। আসলে এই শহরে আমি ছাড়া ওর কেউ নেই। বাবা মাকে খুন করে শহরে বানভাসি মানুষের মত জীবন উৎযাপন করছে । নিজের ভেতরে অপরাধ-বোধ নেই। পাষাণ মানুষ। এই পাথরের ভেতরেই আমি গোলাপের ঘ্রাণ পেয়েছি । ওকে দেখে কখনো মনে হয়নি ও মা বাবাকে খুন করতে পারে। মানুষ গোপনে অথবা প্রকাশ্য কাউকে না কেউকে খুন করে নীরব হয়ে বসে থাকে। তখন পরিচিত খুনি হয়ে ওঠে আমাদের পরম বন্ধু, অথবা কাছের আত্মীয়। নদীর পানির ভেতর বৃষ্টির পানি মিলে গেলে তা আর আলাদা করা যায় না ।

 

খ.

ভোররাতে  হালকা শীত পড়ছে । চোখের পাতা খুলতে পারছি না । পা দিয়ে দুবার চেষ্টা করলাম গায়ে কাঁথা নিতে শেষ পর্যন্ত সফল হলাম। কিন্তু গায়ের সঙ্গে গরম অনুভূত হওয়ায় কিছু একটা আমার শরীর ঘেঁষে আছে । আমার বুকের ভেতর দিয়ে নাভির দিকে নেমে আসছে । হাত দিয়ে কাঁথা সরিয়ে চিৎকার করে উঠলাম। আমার কণ্ঠ শুনে পাশের রুম থেকে কেউ এগিয়ে আসছে না ।

 

 আমি ভয়ে কেঁপে উঠলাম।

এর ভেতর ইলেক্ট্রিসিটি চলে গেল। এ যেন নিজের প্রতি নিজের অবিচার। কাউকে দোষী করতে পারছি না। নিজের নসিব ভালো না হলে যা হয়। তখন প্রিয় কবির পঙক্তি ঠোঁটের ফাঁকা দিয়ে বের হয়ে আসছে বাতাসহীন রঙিন বেলুনের মত ধূসর কণ্ঠস্বরে ।

শোনা গেল লাশকাটা ঘরে

নিয়ে গেছে তারে;

কাল রাতে - ফাল্গুনের রাতের আঁধারে

যখন গিয়েছে ডুবে পঞ্চমীর চাঁদ

মরিবার হল তার সাধ ।

 

মনে হল কিছু একটা আমার শরীর থেকে নেমে গেছে । মোবাইল ফোন সবসময় আমার বালিশের নিচেই থাকে অথচ আজ সারা বিছানাতে খুঁজে কোথাও পাচ্ছি না । আবার বিছানায় শরীর এলিয়ে দিলাম। চোখ বন্ধ করে রাখলেও চোখে ঘুম আসছে না । একবার বিছনার উপর বসে আবার শুয়ে পড়লাম। মনের ভেতর অদ্ভুত সব ভাবনা এসে ভিড় করতে লাগলো ।

আজাদকে আমি মনে মনে প্রচণ্ড ঘৃণা করি। অথচ আজাদের মুখাবয়ব বারবার মনসপটে উদ্ভাসিত হচ্ছে। তাকে মনে করার কিছু নেই তবুও সে আমার সমস্ত অনুভূতি জুড়ে আঘাত করছে । আমি ঘুমিয়ে গেলে মনে হচ্ছে মরে গেছি । আবার জেগে থেকেও মরতে ইচ্ছে করছে। 

ঘুমিয়ে পড়লেও একটি অদ্ভুত সাপ অথবা মানুষের হাত শরীরের ভেতর ঢুকে পড়ে। নিজের শরীর কেঁপে ওঠে। চিৎকার করে কাউকে কাছে ডাকতে চাইলে মনে হয় আমার পাশে কেউ নেই । আমার কথা কেউ শুনছে না । আমার দিকে কেউ এগিয়ে আসছে না । আমার শরীরে কে যেন অকটেন ঢেলে দিয়ে আগুণ ধরিয়ে দিয়েছে । আমি আরও উচ্চ স্বরে চিৎকার করছি, তবুও কেউ আমার কথা শুনতে পাচ্ছে না। তখন মনে হল আমি নিজেই ভুল বলছি, আমার নিজের একজন মানসিক ডাক্তার দেখানো দরকার । আমি গেলাম ও ঠিক তবে ডাক্তারের কাছে গিয়ে কোন লাভ হয়নি । সবাই দেখলাম আমার মত একই সমস্যা নিয়ে ডাক্তারের কাছে এসেছে । আর একজন আসছে তার চোখ বুকের নিচে নেমে আসছে ধীরে ধীরে সে আর কোন মানুষের চেহারা দেখতে পারছে না ।

তার কাছে কে নগ্ন কে পোশাক পরিহিত সবাই এক​। ​ কারণ তার চোখ বুকের নিচে নেমে আসছে​; ​ সে আর মানুষের মুখ দেখতে পারছে না ।

আমি যে চেয়ারটাতে বসেছি ঠিক তার পাশ থেকে উচ্চস্বরে কে যেন বলে উঠলো,

​-​  ডাক্তার আর কোন রোগী দেখতে পারবে না । তার চোখও ধীরে ধীরে বুকের নিচে নেমে আসছে ।  সে কোন মানুষের চেহারা দেখতে পাচ্ছে না। শুধু পা দেখতে পাচ্ছে।

 

 

গ.

 

আজাদ সুমনাকে রাতে একটা চিরকুট দিয়েছে । সেখানে সে লিখেছে, আমরা দুজন মুখোমুখি হতে চাই ?

নিজের প্রতি একধরণের অবিশ্বাস ও ঘৃণাবোধকে পরাজিত করেই শত্রুপক্ষের সঙ্গে মোলাকাত এ বহুত রিস্কি কাজ হলেও মন যখন একবার কোনো কাজের প্রতি সচরাচর সায় দেয় তখন ভেতর থেকে অটোমেটিক্যালি সাহস চলে আসে। সামনে পাথরের পাহাড় পড়লেও তা সরিয়ে সামনে যাওয়া যায়।

সুমনা এমন একটি সুযোগ ও সমায়ের অপেক্ষায় ছিল হয়তো।

ইলশিঘুরি বৃষ্টি তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ব্যাঙের ডাক, মৃদু শব্দ । অনেকদিন বৃষ্টি না হওয়াই রাস্তায় ধুলোময়লা পরিবেশ প্রকৃতির নবরূপের উপর আস্তরণ ফেলেছিল। আজ বৃষ্টিজল ধুয়ে দিয়েছে চারিদিকে প্রকৃতি যেন হাসছে। বৃষ্টি থেকে সৃষ্টি হয়েছে কাদা। রিকসা ভাড়া ত্রিশ টাকা থেকে ষাট টাকা হয়ে গেল শুধুমাত্র বৃষ্টির কারণে। আজ প্রকৃতি মানুষের উপকার বেশি করলেও নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের মানুষকে নাজেহাল অবস্থা করে দিয়ে গেছে অপ্রত্যাশিত নাগরিক বৃষ্টি ।

এই মানুষ গুলো সৃষ্টিকর্তা ছাড়া কারো কাছে বিচার নিয়ে যায় না। কারো কাছে হাত পাতে না। ধীরেধীরে তারা মানুষের মনুষ্যত্ববোধকে জাগিয়ে তুলতে সাহায্য করে ইটের নিচে চাপাপড়া নবাগত বৃক্ষের অঙ্কুরিত চারা গাছটির মতো।

সরষে ফুলের ডগায় মৌমাছি যে বিশ্বাস ও প্রেম নিয়ে বসে। মানুষ তার প্রেমিকার শরীরের উপর তার চেয়ে ভয়ংকর ভাবে বসে। সদ্য-জন্মানো কলির মধু ধুলোময়লার স্তূপের মধ্যে ফেলে চলে যায় নিজের ক্ষমতা দেখানোর জন্য। এই মানুষই অপর মানুষকে ঘৃণা করে। এই মানুষই মানুষের কাছে সাধু। মুখও মুখোশের আড়ালে আজাদের মত মানুষ সমাজে হয়ে উঠছে বিশ্বাসী।

ভাবনার ছেদ পড়লো, পেছন থেকে কে যেন মোলায়েম কণ্ঠে বলে উঠল,

- আজাদ ভাই, আপনি এখানে ?

মেঘের ছায়ার মতো। বিষণ্ণ মেঘ ছেয়ে ধরলো আজাদের রঙিন চেহারা,মুহূর্তে ফ্যাকাসে হয়ে গেল সে।

মনের ভেতর সাতপাঁচ একটা ভাবনা ভাবতেই মৌ বলে, উঠলো,

- জানেন, মিথিলার তো বাচ্চা হয়েছে, আপনি বাবা হয়ে একবারও খোঁজখবর নেননি। এটা নিশ্চয়ই অমানবিক আচরণ। আপনি শিক্ষিত একজন মানুষ। অথচ মিথিলার নামে আপনি কত মিথ্যা অপবাদ দিয়েছেন।

আপনি সুমনার সঙ্গে যে আচরণ করেছেন সেটা নিশ্চয়ই কোন মানুষের কাজ না। একজনকে আপনার ভালো লাগতেই পারে তাই বলে তার সঙ্গে মিশে তাকে পিষে দেবেন এভাবে? কীভাবে পারেন আপনি।

পশ্চিম আকাশে সূর্য ক্রমান্বয়ে আত্মসমর্পণ করছে, তেমনি আজাদের মাথা হেলে পড়তে লাগলো।

ভ্যানিটিব্যাগ থেকে ফোন বের করে, মিথিলাকে ফোন দিলাম। আজাদের কথা বলতেই মিথিলা বলে উঠলো, সে আমার কেউ না !

 

 

 

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন