ক.
কামারহাটের বাতাসে একটা গোপন খবর ইদানীং ঘুরে বেড়াচ্ছে। তা নিয়েই মানুষ কানাঘুষা করছে, জোয়ারের পানি বাড়ার সঙ্গে-সঙ্গে বাতাসের বেগও বাড়ছে। পদ্মার-ঢেউয়ের আঘাতে বাহির বাড়ির ঠাকুরঘর ভেঙ্গে যাবার উপক্রম। ভগবানের নাম জপতে জপতে এ যাত্রায় ঠাকুর রক্ষা করেছে। তা না হলে গাঙের জলে পতিমার মতো নিজেও বিসর্জন হয়ে যেতে হতো এতদিনে। মন্দির রক্ষা করবার জন্য উপজেলায় কাগজ পত্র জমা দিয়েছে পোদ্দার সাহেব। তা কোন কাগজের নিচে চাপা পরে আছে কে জানে।নিজের ব্যবসা বাণিজ্যের খোঁজখবর নিতে পারছি না ঠিকঠাক মতো। টাকা ছাড়া কি কোন কাজ হয়। আজ ক'দিন নিজের শরীর ভাল যাচ্ছে না বলে নিমাইকে পোদ্দার তার মনের দুঃখ প্রকাশ করছে।
──জানিস নিমাই 'সব মানুষই গু খায় দোষ হয় ঘাইরা মাছের।' টাকা পয়সা দিয়েও তো নদী ভাঙন রোধ করতে পারছি না গ্রামের মানুষ সহজ সরল, নেতারা যা বলে তাই বেত, বাইবেল।সত্য কথা হল সবি চোর।
বিশু পোদ্দার দানবীর, গ্রামের মানুষের হৃদয়ে তাঁর নাম খোদাই করে লিখে রাখছে; পরের ভালো আজকাল মানুষ সহজে সহ্য করতে পারে না। কত বার ফিকির-ফন্দি করে রাতে পোদ্দার বাড়িতে ডাকাতি করেছে, ফটিক সরকার ও নিমাই। মানুষের জীবন সবচেয়ে আলাদা জীবন। পশু-পক্ষীর মতো না, দিন এনে দিন খাওয়া। মানুষের জীবনে সংসার আছে, ছেলেপেলে আছে। বাড়তি চিন্তা আছে, ভবিষ্যতের জন্যে কিছু জমাতেই হবে। না হলে শেষ বয়সে ছেলেপেলের উপর চেয়ে থাকতে হবে। পুরুষ মানুষের কাজকর্ম করতে লজ্জা কিসের? সৎ ভাবে বেঁচে থাকলেই হল। এই ভাবনা হলো মনস্তান্তিক ভাবনার বহি:প্রকাশ মাত্র।
──নিমাই, লক্ষ্য করেছিস? রীতার বিষয়টা নিয়ে গ্রামে কু-কথা ছড়িয়ে পড়ছে।
── রাম রাম, এসব কথা মুখে আনাও পাপ।হিন্দুদের ক্ষতি করে সরকার বাড়ির মানুষ এখন সাধু সাজছে, যুদ্ধের সময় পোদ্দার বাড়ির সয়-সম্পত্তি জোর করে লিখে নিছে। স্বর্ণালংকার নিয়েছে। তা দিয়ে শহরে ফুটানি করছে। গাড়ি,বাড়ি করে চাষার লেবাস খুলে অফিসার হয়েছে। বছরে একবার বাড়ি আসবে। বড়ো চার পাঁচটা ষাঁড় কোরবানি দিলে বাড়ির পথে কুত্তার মতো মানুষ লাইন ধরে দাঁড়িয়ে থাকবে, তারা মনে করে গ্রামের গরীব মানুষ তাদের দেবতা মনে করে। ভেতরে ভেতরে ঘৃণা করে। তাদের মুখে এখন কত কথা শোনা যাবে তারা মূলত সাধু সেজেছে প্রকৃত সাধু না।
── নিমাই, মন্দ বলিস নাই। তুই তা হলে যা, পরে আলাপ করবো। বক্কার মিয়ার সঙ্গে দেখা হলে বাড়ির পর আসতে বলিস। হারাম জাদা আমার সঙ্গে দেখাই করছে না । পাটের গদিতে আজ কদিন যেতে পারছি না।
── কাকা শুনলাম,বক্কার মিয়া বিয়ে করছে?
── হুম, আমাকে তো তাই বলেছিল।
রীতা মোসলমান ঘরের মেয়ে, তার একটা দোষ বের হলে আমাদের সমাজের জাত যাবে। হিন্দু হোক মোসলমান হোক সে তো আমার প্রতিবেশী। বক্কার রীতাকে বিয়ে করলে করুক। বক্কার ছেলে হিসাবে সহজসরল,ধর্মভীরু। বিয়ের জন্ন্যিই তাহলে আজ দুদিন বাজারে আসছে না । বাজার সদাই করতেও তো একজন মানুষ দরকার। গরীব মানুষ এতো বিয়ে করবার শখ জাগে কেন? পুরুষ মানুষের আসলে বদঅভ্যাস একবার জড়িয়ে পড়লে নেশার মতো অতো সহজ ভাবে বের হয়ে আসা কঠিন নারী জীবন থেকে।
── বিয়ে কি বদঅভ্যাসের কারণে করে দাদা?
──তা না হলে কি?'
──বক্কার মিয়া, সকালে নতুন বউয়ের সঙ্গে ভাত খাওয়া নিয়ে ঝগড়া শুরু করে দিয়েছে, আপনার এখানে আসার পথে শুনে এলাম।
──নিমাই, তা কি জন্ন্যি বাড়ির পর আসছিস কিছু তো বললি না।
── আমার হাজার পাঁচেক টাকা হাওলাত দিলে বড় উপকার হয় দাদা। সামনের সোমবারে নাজিরগঞ্জের হাটে ধান বিক্রি করে টাকা দিয়ে দেবো।
── ভাল কথা মনে করেছিস, সামনে দূর্গাপূজো, খই, মুড়ির জন্য এক মণ ধান আমার বাড়িতে পাঠিয়ে দিস। তুই বাজারে গিয়ে আমার কথা বলিস, কুঠিতে ক্যাশিয়ার থাকে তাকে কাগজ লিখে দিচ্ছি তোর টাকা দিয়ে দিবে।
── বিশু পোদ্দার কোন মানুষকে কখনো খালি হাতে ফিরিয়ে দিয়েছে, এমন কথা মানুষের কাছে শোনা যায় না। যখন যে কাজের জন্য মানুষ গিয়েছে, কাউকে খালি হাতে ফিরিয়ে দেয়নি। সে বছর উদয়পুরের মিয়া বাড়ির লোকজন বাঁশ নিয়ে গেল চার ভ্যান মাদ্রাসা না-কি জালসার জন্য পরের দিন দেখলাম। গোয়ারিয়ার হাটে কার্তিক পাল সেই বাঁশ কিনে নিয়ে যাচ্ছে। দলীয় লেবাস লাগিয়ে গ্রামে দেখছি কেউ কেউ রাজপ্রসাদ গড়ছে। মানুষ অমানুষ দেখে চেনার উপায় নেই এখন।
পোদ্দারের পাটের কুঠিতে সকাল থেকে সন্ধ্যা অবধি কাজ করে যে টাকা পায় তা- দিয়ে সংসার চালানো কঠিন। বক্কারের বাপ একসময় নৌকা চালাতো, বয়স্ক মানুষ শরীরে কুলায় না। ছেলের সংসারে বসে খাওয়া ছাড়া কোন উপায় নেই । বক্কারের মা গখেন সাহার বাড়ি ঝির কাজ করে, কীর্তন পূজা, অথবা বিশেষ কোন বড় আয়োজন হলে বাড়তি খাবার বেচে থাকলে বাড়ি নিয়ে যায়। বক্কারের বাপের জন্ন্যি, তার ভালোবাসা চোখে পরবার মতো। গবীর মানুষের সখ-আহ্লাদ বলতে আর কি পেটে চারটা পানি ভাত পড়লেই হয়। সারাদিন খাটনির কাজ করা লাগে। কাপড় ছেটো হলে যেদিকে টানা যাবে সেদিক থেকেই শরীর দেখা যাবে। গরিব মানুষের সংসারে অভাব থাকবেই । সকাল বেলা চলে শুধু এক গেলাস পানি খেয়ে, দুপুরে ঢেঁকিতে ধান ভানলে কুলার উপর কয়ডা চাল ঝেড়ে মুখের ভেতর দিয়ে চিবিয়ে দুপুর পার করা। সাঁঝের সময় সমস্ত কাজ শেষ করে খেগেন সাহার বউ শাড়ির আঁচলে খুদ, অথবা চিটা ধানের বাড়া দিলে বাড়িতে এসে চুলায় চুড়িয়ে তা লবণ মরিচ দিয়ে অথবা কোন কোন দিন পেঁয়াচ-মরিচ ছেনে রাতের খাবার খেয়ে স্বামী সন্তান নিয়ে শুয়ে পড়ে বক্কার মিয়া।
খ.
পোদ্দার বাড়ির শান বাধানো ঘাটে গোসল করবার পর ভেজা কাপড় শরীরে পেঁচিয়ে বাড়িতে যাওয়া একটু কষ্ট হয়, এই শীতের দিনে রীতার।
── কি গো বক্কার মিয়া, তোমারে বললাম পোদ্দারের কুটির থেকে আমার সঙ্গে ঢাকায় চলো গেলে না। শুনলাম,বউ বাচ্চার খাবার দিতে পারছো না, সংসারে অভাব বাড়ছে। ছেলে-মেয়ে অসুস্থ তার উপর তোমার বাপ,তোমার ঘারে চাপছে।
── নিমাই কাকা, আমি মূর্খ মানুষ। ঢাকা গিয়ে কি করবো, ঢাকা না-কি অনেক মানুষ থাহে সবাই টাকা পয়সাওয়ালা মানুষ।
── ধুর বেটা, ঢাকার শহরে তোর চেয়ে ফন্নি মানুষের অভাব নাই। তোর ত চরিত্র ভাল আছে, শহরে বিভিন্ন এলাকায় বদ-চরিত্র মানুষ এসে বস্তী বানায় ফেলছে। খারাপ ভালো সবি আছে শহরে। তোর বউ সকালে পোড়া মাটি খায়, ভাত খেতে পায় না। এ কথা একজনের কাছ থেকে গ্রামের সবাই জানে। তোর বউরে দেখতে আসে। মানুষ মুখের সামনে কিছু বলে না। পিছনে মজা নেয়। মানুষ জাতটাই এমন বেহায়ার মত। কেউ উপকার করতে পারলেও করবে না। এখন মানুষ সবচেয়ে বেশি ভয় করে মানুষকে বনের বাঘের চেয়ে বেশি। তুই আমারে বিশ্বাস করলে, তোর জন্যি কথা বলতে পারি।
── নিমাই কাকা, রীতা সকালে পোড়া মাটি দিয়ে দাঁত ঘষতে-ঘষতে অল্প অল্প করে খাওয়া শিখে গেছে। আমি যেমন বিড়ি খাই, বিড়ি না টানতে পারলে মাথা ভার ভার লাগে। আমার বউ পোড়া মাটি না খেলে ওর না-কি ভাল লাগে না। একটা কিছু খেয়ে বেঁচে আছে তাতেও মানুষের কত কথা।' নিমাই কাকা, তুমি যাও তোমার লগে পরে কথা কবোনে।
মনে মনে কি যেন ভাবতে থাকে বক্কার মিয়া, বউয়ের শরীরটা ভাল না। ভাবছি,কবিরাজ বাড়ি নিয়ে যাবো। পরনের কাপড় খানা প্রায় ছিঁড়ে গেছে, পথের লোকজন বউয়ের শরীরের দিকে চাইয়া থাহে। লাজ শরম কিচ্ছু নাই। সংসারের কোন আয় উন্নতি নাই। সারা জীবন পরের বাড়ি কাজ করেই গেলাম। বউরে কোনদিন এক জোড়া কাঁচের চুড়ি কিনে দিতে পারলাম না। নিজের মনের ভেতরে আফসোসের ঢেউ গড়াগড়ি খায় বক্কার মিয়ার মনে। বক্কার মিয়া ঘরের ভেতর ঢুকতেই তার বউ বমি করতে করতে উঠোনে চলে আসলো। কুয়া থেকে পানি তুলে বউয়ের মুখে, মাথায় দিতেই মাটিতে শুয়ে পড়ল। সারাদিন কিছু খায়নি তার মেয়ে ভাঙা ভাঙা কণ্ঠে বলছে,
── বাজান আমিও মায়ের সঙ্গে মাটি খাওয়া শিখে গেছি।
বক্কার মিয়ার চোখ ভিজে ওঠে মেয়ের কথা শুনে। পদ্মাপারের সমস্ত পানি চোখের ভেতরে পোড়া মাটি হয়ে ঢেউ খেলে। পাখির কিচিরমিচির শব্দ, তার কাছে তখন নরক যন্ত্রণার মতো মনে হয়। ভোরবেলা থেকেই গাছের ডালে কাকপক্ষী ডাকছে । তখন থেকেই মনে হয়েছিল আজ একটা খারাপ কিছু হবে। মনের ভেতর মানুষ নিজে নিজে যত কথা বলে সেই কথা আর কখনোই মানুষের সঙ্গে বলা হয়ে উঠে না । মানুষ নিজের সঙ্গেই কথা বলে বেশি।
── বউরে আমার দিকে একটু দ্যেখ।
রীতার চোখ গুলো কেমন ফ্যাঁকাসে হয়ে গেছে। মুখ মলিন হয়ে পরে আছে মাটিতে। কথা বলছে না, মনে হয় জ্ঞান হারিয়ে ফেলছে। নাক দিয়ে মৃদু বাতাস বের হচ্ছে, দাঁত লেগে আছে। ঘর থেকে পানের বোটা নিয়ে এসে যেই রীতার কানের ভেতর দেওয়া হলো। সঙ্গে সঙ্গে নড়াচড়া দিয়ে উঠে পড়ল। স্বামীর মুখের দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ। বাড়ি ঘরের দিকে কেমন তাকিয়ে রইল। ভাব চক্কর দেখে মনে হচ্ছে রীতা এ বাড়িতে নতুন এসেছে। বউ বাচ্চার দিকে তাকালে মায়া করে।
নিমাই, বক্কারের বউয়ের অসুস্থতার কথা শুনে দেখতে এসেছিল। রাক্ষস চোখে নিমাই কাকার মুখের দিকে চেয়ে রইল খানিকক্ষণ রীতা।
নিমাই কৌশল করে বলছে,
── বক্কার তোর বউয়ের জন্য ডাব নিয়ে এসেছি, তারে ডাবেব পানি খাওয়া, হাকিম কবিরাজের কাছ থেকে একটু তেল পড়া নিয়ে এসেছি। মাথায় দিয়ে দে, ঠিক হয়ে যাবে।
কথা গুলো কেমন যেন রীতার শরীরে গিয়ে তীরের মতো বিঁধল। সে বুঝতে পারত নিমাই কাকার দৃষ্টি ছিল তার শরীরের দিকে।
রীতা জোড়ে চিৎকার করে বলল,
── এই ডাকাত আমাগো বাড়িতে ক্যান। পোদ্দার বাড়ির তা খায়ছে নিমকহারামি,
তাকে দেখেই আমি চিনছি। সেই তো ফটিক সরকারের সঙ্গে ডাকাতি করে রাতের বেলায়।
বক্কার ওঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে নিমাই অদৃশ্য হয়ে গেল।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন