shafiq nohor

মঙ্গলবার, ১ নভেম্বর, ২০২২

গৃহবন্দি বিড়াল ।। শফিক নহোর



মিনু কলেজ থেকে ফিরে আসার পর তার মা জানিয়ে দিলো, তার আদরের বিড়ালটাকে বাড়িতে রাখা যাবে না। মানুষই খেতেপাচ্ছে না, বিড়াল পুষে কি হবে। তাছাড়া বিড়ালের শরীরে ঘা হয়েছে। পরের দিন মিনু কলেজে যাবার পর তার মা বাড়ির কাজের ছেলে রহিমের সহযোগিতায় বস্তায় ভরে বিড়ালটাকে জঙ্গলে ফেলে দিয়েছে।

 

বাড়িতে ঢুকেই মিনু কিছু একটা আন্দাজ করতে পারছে, 'ডাল মে কুছ কালে হে।'

 

কাঁধের ঝোলা-ব্যাগটা টেবিলের উপরে রাখতেই তার মা কিছু একটা বলতে চাইলেন। কথা ঠোঁটের কিনারে আসতেই হাত ইশারা করে মিনু বলল, আমি সব জানি। তোমাকে কিছুই বলতে হবে না। এরপর মায়ের মুখের দিকে বিষদৃষ্টিতে খানিকক্ষণ চেয়ে থেকে ওয়াশরুমের দিকে রওনা হলো।

 

 

সামনের মাসে ফাইনাল পরীক্ষা মিনুর। এর ভেতর দু'জন বিয়ের ঘটক বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে এসেছিল। একজন ইতালিতে থাকে ভালো চাকরি করে। অন্য একজন অঢেল টাকার মালিকের ছেলে। সে অবশ্য রাজনীতি করে। মিনুর কানে এখনো পৌঁছায়নি তার বিয়ের জন্য বাবা মা দু'জন ভেতরে ভেতরে ছেলে দেখছে। মিনুর মায়ের কথা হলো, মেয়ে মানুষ যতই শিক্ষিত হোক স্বামীর ভাত রান্না করতেই হবে। বাচ্চাকাচ্চা, নাতিপুতি মানুষ করতে হবে। জীবন সুন্দর অল্প বয়সে বিয়ে করে স্বামীর সঙ্গে রোমান্টিক সময় পার করা হলো বুদ্ধিমানের কাজ। মেয়ে মানুষের আহামরি শিক্ষিত হয়ে কি হবে। যারা ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার হচ্ছে তারাওএকটা সময় স্বামী, সংসার নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পরে। মিনুর মায়ের কথা হচ্ছে, মানবজীবন অতি সংক্ষিপ্ত। সেখানে নিজের জন্য সময়ব্যয় করা হলো সর্বোচ্চ বুদ্ধিমানের কাজ। নারী শিক্ষার বিপক্ষে তিনি নন। তিনি জীবন, যৌনতা, বেঁচে থাকা ও পরজন্ম নিয়ে চিন্তিত, জীবনবোধের গভীরতা তাঁকে মুক্তি দেয় না। ভাবতে শিখায় নতুনভাবে সু-মানুষ, সুনাগরিক, সুখী সাংসারিক দাম্পত্যজীবন তার কাছে সবচেয়ে দামি ও মূল্যবান।  মূল্যবোধের-চর্চা মানুষের ভেতরে না থাকলেও এলিটদের সমিতিতে দৃশ্যমান। সেখানে নিজেকে জাহির করার নানান কৌশল অবলম্বন করতে হয়।

 

 

মেয়েকে বলতে চেয়েও ঠোঁটের কার্নিশে ঝুলে থাকলো প্রেমময় টকসিন সেসব কথা। কথার ভেতর কথা চালু হয়ে গেলে ওঝা যেমন করে সাপের বিষ নামায়, তখন শুধু কথাই বলতে হয় সত্য না মিথ্যা নজর দেয় না কেউ-তেমনি সবার একটাই উদ্দেশ্য জয়ী হওয়া। তাতে মানুষের ক্ষতি হলেও সেদিকে নজর থাকে না কারো। কেউ কাউকে ক্ষতি না করলে, না ঠকালে ভেবে নেয় তার জয়হবে না। আসলে মানুষ তার ভাগ্য-সুপ্রসন্ন করতে পারে না, কারণ কঠোর পরিশ্রম করেও তার তকদির থাকতে হবে। না হলে আফগানের পাথর ভাঙা সেই বৃদ্ধা আজ পরিশ্রম করে ধনী হয়ে যেত। মেয়ের ভালো একটা পাত্র দেখে বিয়ে দিতে পারলেই মিনুর মায়ের শান্তি।

 

 

 

 

এদিকে সে মেয়েকে মনে মনে ভয় পায়। মেয়ে হলো ঠোঁটকাটা, যে কোনো কঠিন কথা মানুষের সামনে বলে দেয়। চক্ষুলজ্জা নাই। নারীর সবচেয়ে বড় শত্রু হলো নারী। নারীর অমঙ্গল নারীই কামনা করে। অথচ, এই নারী যখন মা হয়ে যায় তখন সে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ মানুষ। মেয়ের কাছে অথবা মায়ের কাছে। যোজন যোজন দূরত্ব তৈরি হলেও মনের ভেতর মানুষের সঙ্গে মানুষের যে সম্পর্কথাকে, সেটা হলো আত্মার অস্তিত্বের  নিবিড় এক অদৃশ্য সম্পর্ক। সেটাই মানুষকে সাহসী করে তোলে। হ্যাঁ, সে পুরুষও হতে পারে নারীও হতে পারে । আত্মাকে পরিশুদ্ধ রাখা হলো মানুষের কাজ। অথচ, লোভ ও হিংসাত্মক তৎপরতা আমাদের ঘর থেকে সংসার, অথবা সমাজ নিজেদের স্বার্থ ছাড়া আমাদের এখন অন্যকিছু নিয়ে ভাবতে উৎসাহিত করে না। কথার যাদু-বানে মিনুডুবে যাবে না এ বিশ্বাস তার মায়ের ছিল। অথচ, শফিক একজন দরিদ্র কৃষকের সন্তান তার প্রেমে পড়বার কি এমন আছে । তার মা নয় ছয় হিসেব কষতে থাকে অথচ মিলাতে পারে না।

 

 

 

 

 

ফাইনাল পরীক্ষার শেষের দিন মাইক্রোবাস অ্যাকসিডেন্ট করে পঙ্গুত্ব বরণ করতে হয়েছে মিনুকে। এখন বেঁচে থাকা কঠিন। বাঁচার মতো বেচেঁ থাকতে সবাই পারে না। ডাক্তার একবার আশার বাণী শোনালেও মনের জোড়ে কিছুই বলতে পারছে না মিনুরমাকে। অসীম অভাবে মানুষ মনস্তাত্ত্বিক চিন্তাবোধ ভেদ করে লোভের ফাঁদে নিজেকে মিলিয়ে ধরলেই গৃহবন্দি বিড়াল জীবন-ইচ্ছেকরেই বরণ করছে। অথচ, আমরা জীবনকে কঠিন থেকে কঠিন করছি। মিনু বিছানায় শুয়ে শুয়ে ভাবছে, তার সুন্দর জীবনটা কেমন নষ্ট হয়ে গেল। আয়নার সামনে হুইলচেয়ার নিয়ে নিজের চেহারা দেখে, আর বিভিন্ন ভাবনা তার মাথায় ভর করে। তার ভাবনাগুলো সে নিজের ডায়েরিতে লিখে রাখে। যদিও ডাক্তার তাকে কোমায় রেখেছিল ন’মাস। সেখান থেকে ফিরে আসতে পারবে, এমনটা পরিবার আশা করেনি। দোয়ায় দরিয়া পার-এমন একটা কথা প্রচলিত আছে। কোমা স্টিমুলেশন থেরাপি দেওয়ার পর সেস্বাভাবিক হতে থাকে ধীরে-ধীরে। ভালো রেজাল্ট করলেও বিশ্ববিদ্যালয়ে পা রাখা হয়নি। বাবার অঢেল সম্পত্তি থাকলেও মেয়ের জন্য নিরাপদ একটি ঠিকানা দরকার। মিনুর মা তার মেয়েকে নিয়ে এমন একটা ভাবনায় বিভোর।

 

 

মোবাইল ফোনের রিংটোন বেজে উঠলো। ফোনটা ধরতেই ওপাশ থেকে বলল, "আসসালামু আলাইকুম ভাবী। ফিরোজ ভাই মেয়ের বিয়ের জন্য একটা ছেলে দেখতে বলেছিলেন। তিনি ব্যস্ত মানুষ তাই আপনাকে মুঠোফোনে বলছি, শোনার সময় হবে ভাবী?"

 

কি যে বলেন ভাই! আপনি ফোন করেছেন আর আমি শুনবো না। বলুন, ছেলে কি ঘরজামাই থাকতে রাজি কি না!

 

আমার মেয়ে অসুস্থ হলেও অর্থ-সম্পত্তি কম নেই, সুখ একদিকে কম হলেও অন্য দিকে সুখের নহর বয়ে যাবে।

 

আপনি ছেলের পরিবারের সঙ্গে কথা বলে দেখুন, তারা কবে আসতে চায়। কিছু মনে না করলে আমি ড্রাইভারকে বলে দিচ্ছি সে আপনাদেরকে গিয়ে নিয়ে আসবে।

 "না না ভাবী তা লাগবে না। খুব কাছেই তো আপনার বাসা।"

 

রহিম ভাই, বাসা না ঠিক বাড়ি!

কথার যাদু-বানে রহিম সাহেব বুঝতে পারলেও, সেভাবে কথাটি ধরেনি। তাছাড়া সমাজে যাদের অর্থ-বিত্ত আছে তাদের কথা ভুল হলেও সেটাই যেন আইনের সনদ।

 

 

ভেজাল মানুষ, ভেজাল খাদ্য মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে। কে কার খবর রাখে এখন। টাকার ঘ্রাণে নিজেরই মনুষ্যত্ব, বিবেকবোধ বিলুপ্তির দ্বারপ্রান্তে হোঁচট খাচ্ছে। অধর্মের বাতি ধাও ধাও করে জ্বলছে সমাজ, সংসার, রাষ্ট্রের মধ্যে। এলিট শ্রেণীর প্রজনন ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে ব্যাঙের ছাতার মতোই অথচ, খেটেখুটে যারা খায় দিনশেষে ঘরে খাবার নিয়ে যাওয়া কষ্টকর হয়ে দাঁড়ায় তাদের জন্য। হ্যাঁ, এটা সত্য কেউ না খেয়ে নেই। তবে যা খেতে চায় তা খেতে পারে না। অসীম অভাব, সীমিত সম্পদমানব জীবনকে গৃহবন্দি বিড়াল জীবন করে ফেলেছে।

 

 

মিনুর স্বপ্ন অধরা, আবেগহীন অপ্রকাশ যোগ্য। তার মা যেখানে পাত্র দেখে বিয়ে করাবেন, সেখানেই তাকে সংসার করতে হবে।

 

রাতে মিনুর মা রুমে ঢুকে বলল, নিজে তো কিছু করতে পারবে না। নিজের বাপের ধনসম্পত্তি ছিল তাই স্বামী কপালে জুটছে। আজকাল কেউ ঠ্যাঙ ভাঙা গরু কোরবানি দেয় না। সবাই একটু জাতে উঠতে চায়। নিজের দিকে তাকিয়ে দেখ।

 

 

 

 

এরপর কাকতালীয় ভাবে বিয়ে হয়ে গেল। বিয়ে হয়ে গেলেও মিনুর মনের ভেতর যোগ-বিয়োগ হতে লাগল। শফিক কে মন থেকে ভুলতে পারেনি। জীবন যখন ডুবে যাওয়া সূর্যের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে দৌঁড়াতে থাকে তখন শফিক তার সঙ্গে ছিল। সামাজিক মর্যাদার দিক থেকে মিনুর পরিবার মেনে নেয়নি শফিককে। এখানে ভালো থাকা, সুখে থাকা মানেই এলিট শ্রেণীর একজন শিক্ষিত পুরুষের কাছে নিজের কন্যাকে তুলে দিতে পারলে পরিবার একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছাড়ে! এই চিত্র সে কোন ভাবেই ভেদকরতে পারেনি। কোন কোন পরাজয় হয়তো জয়ের চেয়ে বড় পাওয়া।

 

কে এখানে?

আমি!

 

আমি কে?

 

নিশ্চুপ থাকে শুভ। নিজেকে আড়াল করতে ব্যস্ত।

 

নরম কণ্ঠে মিনু বলল, মিথ্যা বলছো কেন?

 

তোমার বিশ্বাস হয় আমি তোমাকে মিথ্যা বলব?

 

মিনু কিছুক্ষণ নিবর থেকে সামনে এগিয়ে গেল। দরজা খুলে বারন্দার গ্রিল ধরে দাঁড়াল।

 

ফেলে দেওয়া সেই বিড়াল এত বছর পর আবার বাড়িতে ফিরে এসেছে। অথচ, মিনু হাত বাড়িয়ে তার আদরের বিড়ালকে কাছে টেনে নেয়নি। সময়, অনেক প্রিয় জিনিস অপ্রিয় হয়ে ওঠে-হয়তো তেমন কিছুই। অতিরিক্ত আবেগ, অতিরিক্ত ভালোবাসা-বেদনার সৃষ্টিবৃক্ষ।

 

 

বিয়ের পর থেকে স্বামী, সংসার-এ বিষয়গুলো মিনু তেমন একটা বুঝতে পারেনি। কখনো কখনো শুভ তার কাছে গেলেও শফিক ভেবে সে কিছু বলেনি। কোন কোনদিন এমন হবার কথা তখন মিনু চিৎকার করে উঠতো, এই চিৎকার সাত আসমান ছিদ্র হয়ে আরও উপরে উঠে যেত! তখন চোখে বেয়ে জল গড়িয়ে পড়তো। হাতের কাছে কোন কিছু পেলে ভেঙে ফেলতে চাইত।

 

শুভ বাড়ি পলাতক শিশুর মত মিনুর পেছনে দাঁড়িয়ে থাকতো। স্রোতের বিপরীতে নৌকা নিয়ে যাওয়া গেলেও মনের অমতে জীবনসঙ্গীকে নিয়ে সংসার জীবন করা যায় না। এই সমাজ, সংসার, পরিবার এই সত্য মেনে নিতে পারে না সহজে। ভুল মানুষের সঙ্গে, অপছন্দের মানুষের সঙ্গে সংসার আর সন্তানের মোহে নিজের আনন্দকে বিসর্জন দিতে হয় শুধু পরিবারের মুখের দিকে তাকিয়ে।এই সংসার জীবনে মানুষ কতটা অসহায়-তা কল্পনাতীত।


শফিক এখন ছায়া মিনুর কাছে। তার শরীর বাতাসে মিশে গেছে অলিক ঘ্রাণে। শফিক পাশেই থাকে অথচ, দেখতে পায় না। মনের ভেতর একটা ভয় হতে থাকে। যদি কোন কারণে মিনু আমার থেকে হারিয়ে যায়। শূন্যতার ভেতর ডুবে গেলে হারিয়ে ফিরে পাবার আশা বোকা মানুষ ছাড়া কে করবে? দুজন ভিন্ন রকম চিন্তায় ডুবে থাকে। কেউ কাউকে খুঁজে পাচ্ছে না আগের মত করে। ভালোবাসার মানুষ একটু পরিবর্তন হলেই মনে হয় সে পরিপূর্ণ বদলে গেছে। এক আত্মা অপর মানুষকে আগের মতই পেতে চায়। কিন্তু?

 

মানুষ মরে গেলেও কথা বলতে পারে।

 

অথচ, মিনু সারাদিন শফিকের চোখের সামনে দাঁড়িয়ে থেকেও এত কথা কখনো বলেনি।


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন