বেলা রানী আমাদের
গ্রামের মেয়ে।
ও
ছিল
আমার
শৈশবের
খেলার
সাথি।
আমরা
কামারহাট সরকারি
স্কুলে
একসঙ্গেই পড়তাম।
বেলা
রানী
জেলেপাড়ার মেয়ে।
এ
জন্য
তাকে
কেউ
পছন্দ
করত
না।
উঁচু
জাতের
ছেলে-মেয়ের সঙ্গে ওর
খেলাধুলাকে গ্রামের কেউ
কেউ
অপরাধ
হিসেবে
বিবেচনা করত।
তখন গ্রামে জগো
পাগলি
নামের
একটা
মেয়ে
ছিল।
আমরা
তাকে
পেছন
থেকে
ঢিল
ছুড়ে
মারতাম।
ঢিল
দিয়ে
খেজুরগাছের আড়ালে
লুকিয়ে
যেতাম।
ঢিল
খেয়ে
জগো
পাগলি
পেছনে
ফিরে
দেখত
কেউ
নেই।
জগো পাগলি মনের
সুখে
গান
গাইত।
ধুলো
পড়া
রাস্তা
দিয়ে
এগিয়ে
যেত
নদীর
পারে।
সারা
দিন
এবাড়ি-ওবাড়ি ঘুরত। কখনো
কখনো
একা
একাই
উঁচুস্বরে হেসে
উঠত,
আবার
কখনো
দুই
চোখের
ধারা
মাটিতে
গড়িয়ে
পড়ত।
মাঝেমধ্যে নিজের
চুল
নিজেই
টেনে
টেনে
ছিঁড়ত।
কাজ
একটু
কম
করলে
পাতে
খাবারও
কম
উঠত।
ঘানি
টানার
গরু
থাকা
সত্ত্বেও তাকে
দিয়েই
ঘানি
টানানো
হতো।
জগো
পাগলির
আরেকটা
কষ্ট
ছিল—পাখিডাকা ভোরে কুয়ো থেকে
পানি
তুলে
রান্নাঘর থেকে
শুরু
করে
গোয়ালঘর পর্যন্ত দরকারি
পানির
জোগান
দিতে
হতো।
কোনো
কোনো
দিন
সকালে
বা
দুপুরে
না
খেয়ে
থাকতে
হতো।
পাতিলপোড়া ভাত,
মাছ
ছাড়া
তরকারি
ছিল
প্রায়
প্রতিদিনের রাতের
খাবার।
নিয়মিতই সংসারের ঘানি টানছে জগো
পাগলি।
কুয়োর
জলে
জগো
পাগলি
দড়িবাঁধা কলস
ফেললে
জলের
ভেতরে
দুটো
মুখ
চাঁদের
মতো
হেসে
উঠত।
জলভর্তি কলস
ওঠানোর
সময়
কিছু
জল
ছলাতছলাত করে
নিচে
পড়ত।
তখন
মনে
হতো
জগো
পাগলির
চোখের
জল
কুয়োর
পানিতে
গড়িয়ে
পড়ছে।
জগো
পাগলি
একটা
সময়
ঘানি
টানতে
পারত
না।
সত্মা
রাতে
আধাথালা খাবার
দিত।
যে
কারণে
কিছুদিন পরই
কেমন
যেন
নেতিয়ে
পড়েছিল। তার
পরও
সত্মা
জোর
করে
ঘানির
জোয়াল
কাঁধে
তুলে
দিত।
দুই চক্কর পরই
জগো
পাগলি
কেঁদে
কেঁদে
বলত,
‘মা
গো,
আর
পারছি
না।
আমারে
তুমি
মেরে
ফেলো।’
—হারামজাদি সংসারে
খাবি,
আর
ঘানি
টানবি
না?
মরলে
তো
শান্তি
পেতাম।
মরতে
পারিস
না
পোড়ামুখি।
জগো পাগলি ঘানি
টানতে
না
পারলে
মা
শরীরে
খেজুর
কাঁটার
খোঁচা
দিয়ে
বলত—‘হারামজাদি, ঘানি টানবি না,
বল
টানবি
না?
মুখে
কথা
নাই
কেন?’
তখন সে অশ্রুসাগরে নীরবে
সাঁতার
কাটত,
আর
বেঁচে
থাকার
আকুতি
নিয়ে
ঘানি
টানত।
জগো এসব ঘটনা
বাবাকে
বলত
না।
কারণ
বাবা
এত
কিছু
জানলে
ভীষণ
কষ্ট
পাবে।
শুধু
বলত,
‘মা,
বাবায়
জানি
না
বুঝে,
তুমি
আমারে
এইভাবে
মারছ।’
এ কথা শুনে
সত্মায়ের চোখ
মুহূর্তেই রক্তলাল। নির্মমতায় মায়ের
হৃদয়
শুকিয়ে
মরুভূমি হতে
লাগল।
জগো পাগলি সব
কিছু
বুঝতে
পারত।
বাড়ির
ভেতরে
সত্মায়ের অত্যাচার, বাইরে
মানুষের ঢিল।
কেউ
কেউ
পোদ্দারবাড়ির জঙ্গলে
নিয়ে
যেতে
চাইত।
ওরা
যেন
মানুষ
নয়,
মানুষখেকো বাঘ।
মনের ভেতরে শিয়াল-কুকুরের কোনো ভয় ছিল
না।
তবে
পুরুষ
মানুষ
দেখলে
ভয়ে
পিলে
চমকে
যেত।
জগোর বাবা আলাভোলা মানুষ।
বউ
তাকে
শাড়ির
আঁচলেই
পেঁচিয়ে রাখত।
মেয়ে
লতার
মতো
বড়
হয়েছে,
সে
খেয়াল
আলতাপ
শেখের
নেই।
ভোরবেলা তেলের
ঘটি
নিয়ে
গাওয়ালে বের
হতো,
সন্ধ্যায় বাড়ি
ফিরত।
একদিন
চাঁদিতে হালকা
তেল
মেখে
গায়ে
পানি
ঢালতে
ঢালতেই
জগোকে
বলল,
—তোর
মায়েরে
ক
আমার
জন্যি
ভাত
বাড়তে।
খিদায়
মনে
হচ্ছে
পুরা
দুনিয়া
চাবায়া
খাই।
—বাজান,
তোমার
তবন
আর
গামছা
নিয়া
আইতাছি—বলেই জগো কেমন
জানি
গোঙানি
দিয়ে
উঠল।
মুখ
বেয়ে
লালা
পড়তে
লাগল!
হুট
করে
মাটিতে
গড়িয়ে
পড়ল।
আলতাপ শেখ বউকে
ডাক
দিয়ে
বলল,
‘শুনছ
নাকি?
জগো
মাটিতে
পইড়া
গেছে,
ওরে
ঘরে
নেও।’
—মাগি
বাপরে
দেখলে
আহ্লাদ
দেখায়।
শোনো,
তোমার
মেয়ে
তিন
বেলা
বইসা
বইসা
খাইব।
সংসারের চাইর
আনার
কাম
তো
দূরের
কথা,
ভাতে
জ্বাল
দিতেও
চায়
না।
অহন
ঢং
দেখায়া
মাটিতে
পইড়া
গেল!
তোমারে
বুঝাইতে চায়,
আমি
সত্মা।
ঠিকমতো
খাওন
দেই
না।
মাইনসে
দেইখ্যা আমারে
আর
তোমারে
মন্দ
বলুক।
তুমি
অর
বাপ,
তাই
বুঝো
না।
আমি
ঠিকই
বুঝি।
আলতাপ শেখ গোসল
করে
তবন
উঠানের
তারে
ছড়িয়ে
দিয়ে
ঘরের
বারান্দায় গিয়ে
বলল,
‘মা
মরা
মেয়ে।
ওরে
একটু
দেইখ্যা রাইখো,
বউ।’
—আমি
তোমার
সংসার
দেখব,
না
ঘানি
টাইনে
তেল
বাইর
করব।
তেল
যদি
না
হয়
গাওয়ালে গিয়ে
কি
বেচবা?
বেচা
না
থাকলে
কী
খাইবা?
—আমারে
আর
জগো
রে
খাইতে
দেও।
—তোমার
মাইয়া
খায়ার
ভান
ধরছে।
তুমি
খায়া
নেও।
মাগির
শরীর
ভর্তি
তেজ।
রাতের অন্ধকার যত
গভীর
হয়,
জগোর
পেটের
ক্ষুধা
ততই
বাড়তে
থাকে।
ওর
শরীর
কাঁপতে
শুরু
করেছে।
এবার
সে
রান্নাঘরে ঢুকে
পাতিল
থেকে
এক
থালা
ভাত
নিয়ে
পিঁড়ি
পেতে
বসেছে।
মুখে
এক
নলা
ভাত
দিতেই
সত্মায়ের চোখ
ভাতের
থালায়
পড়ল।
মুখ চেপে বাইরে
নিয়ে
এলো
সত্মা।
রাতের
অন্ধকারে কুয়োর
ভেতর
ফেলে
দিল!
বেঁচে
থাকার
আকুতিতে মায়ের
হাত
চেপে
ধরল।
কিন্তু
সত্মায়ের কাছে
ওটা
ছিল
মিথ্যা
বাহানা। ওর
চোখে
ছিল
সমস্ত
পৃথিবীর আবেগ।
মাটির
কলসি
ধরে
সারা
রাত
বেঁচেছিল জগো।
ভোররাতে আলতাপ শেখ কুয়ো
থেকে
পানি
তুলতে
গেলে
কলসির
সঙ্গে
ফ্যাকাসে জগোও
ওঠে
আসে।
তখন
আলতাপ
শেখ
চিৎকার
করে
বলে,
‘মায়ের
শোক
সইতে
পারলি
না
রে
মা।
শেষ
পর্যন্ত কুয়ায়
ডুইবা
মরলি...। আমি কি
তোরে
ভালাবাসতাম না
রে
জগো...’
চিৎকার শুনে বাড়ির
পাশের
লোকজন
এসে
ভিড়
করতে
লাগল।
মানুষের মুখে
মায়ের
মুখোশ
থাকলে
কাছের
মানুষও
কিছুই
বুঝতে
পারে
না।
এদিকে জেলেপাড়ার মেয়ে
বলে
বেলা
রানী
শৈশবে
জীবন
থেকে
হারিয়ে
ফেলেছিল সমস্ত
রকম
রঙিন
দিন।
জীবনে
বেড়ে
ওঠার
জন্য
কেউ
কখনোই
সুযোগ
দেয়নি।
আঘাত
করেছে,
ভুল
ধরেছে।
সন্ধ্যায় কানছিকোনায় গেলে
কেউ
লুকিয়ে
থাকত,
ঢিল
ছুড়ে
মারত।
বেলা
রানী
সহজে
সমাজের
কারোর
কাছে
হেরে
যায়নি।
অনেকগুলো রাক্ষুসে হাত এগিয়ে আসত
রাতের
আঁধারে। বেলা
রানীর
পরিবার
সঙ্গ
দিত,
সাহস
দিত
এগিয়ে
যাওয়ার। শেষ
পর্যন্ত বেলা
রানীর
সঙ্গে
আমার
দেখা
হয়েছিল
নিকষ
কালো
অন্ধকার রাতে।
তার
গায়ের
ঘ্রাণেই আমি
বুঝেছিলাম, সে-ই
বেলা
রানী।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন